১৯৮৪ সালে বাংলাদেশের বুকে অনেকগুলো জেলার মত শরিয়তপুর জেলা নামে একটি জেলা জন্ম নেয়, যার নাম করন করা হয়েছিল ফরায়েজী আন্দোলনের রুপকার উপমহাদেশের বিখ্যাত ইসলামিক চিন্তাবিদ হাজী শরিয়তুল্লাহ এর নাম অনুসারে। যে জেলায় জন্ম গ্রহণ করেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বীর সন্তানেরা, যাদের ছোয়ায় স্বাধীনতা আন্দোলনে পেয়েছিল নতুন উদ্দ্যম, শক্তি প্রেরনা। যাদের আসাধারন নেতৃত্বে স্বাধীনতার পথ সুগম হয়েছিল। কিন্তু আজ দুঃখের সাথে বলতে হয়,এত বড় বড় বীর সন্তান জন্ম যে জেলার মাটিতে, সে জেলাটি উন্নয়নের দিক দিয়ে অনেকটাই অবহেলিত জেলা। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও যার সুত্রপাত হয়েছিল সেই ভাষা আন্দোলন দিয়ে। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতা আন্দোলন পর্যন্ত মাতৃভূমি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও অধিকার রক্ষার জন্য যত আন্দোলন হয়েছিল সব আন্দোলনেই শরিয়তপুর জেলার কৃতি সন্তানদের ছিল আসামান্য আবদান। ভাষা আন্দোলনে শরিয়তপুরের কৃতি সন্তান ডাঃ গোলাম মাওলার অবদান ছিল অনস্বীকার্য। এমনকি তিনি আমাদের ভাষা আন্দোলনের স্মৃতির প্রতীক শহীদ মিনার তৈরিতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। স্বাধীনতা আন্দোলনের আগে আরও অনেকগুলো আন্দোলন হয়েছিল ১৯৬২,১৯৬৪,১৯৬৬ সালের ছাত্র আন্দোলন ও ১৯৬৯ সালের গন-অভ্যুথান ইত্যাদি।যার শেষ পরিনতি হল ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ। ১৯৬২, ১৯৬৪ ও ১৯৬৬ সালের ছাত্র আন্দোলনে শরিয়তপুরের কৃতি সন্তান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম বীর আব্দুর রাজ্জাক নেতৃত্ব প্রদান করেন। ১৯৬৫-১৯৬৬ ও ১৯৬৬-১৯৬৭ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান ছfত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেফতার হলে তার অবর্তমানে আব্দুর রাজ্জাক ৬ দফা আন্দলনের নেতৃত্ব দেন। ১৯৬৯ সালের গন-অভ্যুথানে তিনি একজন সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি মেঘালয় সেক্টরের মুজিব বাহিনীর প্রধান ছিলেন। সেখান থেকে তিনি থেকে মহান মুক্তিযুদ্ধে জাতীয় বীরের ভূমিকা পালন করেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে শরিয়তপুরের আরেক কৃতি সন্তান বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পীকার কর্নেল শওকত আলী আসাধারন অবদান রাখেন। ১৯৬৮ সালে বঙ্গবন্ধুর সাথে তিনিও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামী হন এবং কারাবরণ করেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাক বাহিনী নিরীহ বাঙ্গালীর উপর নির্মম নির্যাতন চালায় ও বঙ্গবন্ধুকে ধরে নিয়ে যায়। পাকিস্তান বাহিনীর নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ কারার জন্য তিনি মুক্তিযুদ্ধাদের সংগঠিত করে প্রশিক্ষন দেওয়া শুরু করেন। ১৯৭১ সালের ২৫ এপ্রিল মাদারীপুর মহকুমার (বর্তমান শরিয়তপুর ও মাদারীপুর) পতন হলে তিনি মুক্তিসেনাদের নিয়ে ২ সেক্টরে যোগ দেন। এখানে তিনি সাব-সেক্টরের কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ অঞ্চলের আরেক কৃতি সন্তান এডভোকেট আবিদুর রেজা খান যিনি ১৯৬৬ সালে ৬ দফা ও ১৯৬৯ সালে আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামীদের মুক্তির জন্য তিনি আইনজীবী হিসেবে লড়েছেন অকুতভয়ে। ২৫ মার্চের পর তিনি ভারতে গিয়ে বাংলাদেশের সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। সেখান তিনি মুক্তিযুদ্ধাদের আশ্রয় ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। তিনি ছিলেন ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির অন্যতম সদস্য। এছাড়াও ডাঃ আবুল কাশেম, আমিনুল ইসলাম দানেশ, নুরুল হক হাওলাদার, বিপ্লবী রাজনীতিবিদ সিরাজ সিকদার, এম এ রেজা বীর প্রতিক ক্যাপ্টেন আব্দুর জাব্বার খানঁ, নিতাই গোপাল পাল সহ অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রেখে গেছেন। শরিয়তপুরের কৃতি সন্তানদের মধ্যে যার শহীদ হয়েছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন সাধনা ঔষধালয়ের প্রতিষ্ঠাতা এদেশের আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের কিংবদন্তী শহীদ বুদ্ধিজীবী ডঃ যোগেশ চন্দ্র ঘোষ, শহীদ সরদার সিরাজউদ্দিন আহমেদ, ঢাকা মেডিকেল কলেজে সংসদ ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি শহীদ বুদ্ধিজীবী ডাঃ হুমায়ুন কবীর, ১৯৭১ সালের নবগঠিত বাংলাদেশ সরকারের বিদ্যুৎ ও শক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা শহীদ বুদ্ধিজীবী প্রকৌশলী নজরুল ইসলাম, জনাব আক্কাস, ইঞ্জিনিয়ার বাদশা আলম শিকদার, সরদার মহিউদ্দিন, ও ডাঃ কাঞ্চন। এছারাও মুক্তি শহীদ হয়েছিলেন নাম জানা-অজানা অনেক মুক্তিযুদ্ধা। যাদের অসামান্য অবদানের কারনে আজ আমরা পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশ নামে একটি দেশে মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে আছি।
লেখকঃ রেদোয়ান মাসুদ রানা,
কবি ও লেখক
(জাজিরায় জন্মগ্রহনকারী)
১৯৭১ সালে শরীয়তপুরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণহত্যা
নড়িয়ায় গণহত্যা
১৯৭১ সালের ২২ মে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ৫০ জন সেনা নিয়ে লঞ্চের করে মাদারীপুর থেকে শরীয়তপুরের নড়িয়ায় আসে। এখানে এসে ঘড়িসার বাজার, ঝালোপাড়া ও ঘোষপাড়া গ্রামগুলো জ্বালিয়ে দেয়। ঘোষপাড়া গ্রামের নালিত ঘোষকে ধরে একটি গাছের ঝুলিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। সেই সঙ্গে পূর্ব নড়িয়া গ্রামের নাসিমা বেগম, কানাই ছৈয়ালকে গুলি করে হত্যা করে পাকিস্তানি সেনারা। লোনসিং গ্রামে এসে এখানে চারজন পুরুষ ও তিনজন নারীকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
ভেদরগঞ্জের মহিষার গণকবর
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ভেদরগঞ্জের মহিষারে দুই শতাধিক পাকিস্তানি সেনা ও তাদের দোষরদের সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর সম্মুখযুদ্ধ হয়। এতে ১১ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। মহিষারেই ওই ১১ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধাকে গণকবর দেওয়া হয়।
পালং মধ্যপাড়া গ্রামে বধ্যভূমি
১৯৭১ সালের ২২ মে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকাররা শরীয়তপুরে পালং থানা (এখন সদর উপজেলা) মধ্যপাড়া গ্রামে আক্রমণ চালিয়ে অসংখ্য নারী-পুরুষকে ধরে নিয়ে নির্যাতন ও হত্যা করে। এখানে রাজাকারদের সহযোগিতায় নীলকান্দি, কাশাভোগ এলাকার হিন্দু–অধ্যুষিত এলাকায় ব্যাপক অত্যাচার চালিয়ে প্রায় তিন শতাধিক মানুষকে হত্যা করে। হত্যার পর তাঁদের মনোহর বাজারের আশপাশে গণকবর দেওয়া হয়।
এ ছাড়া সদরের উত্তর দক্ষিণ মধ্যাপাড়া, মালো পাড়া, ঝালো পাড়া, কাশাভোগ, নীলকান্দি, আংগারিয়া বাজার, ধানুকা, পাল বাড়ি, কোটাপাড়া বাজার, নড়িয়া থানার গোলার বাজার, তেলিপাড়া, ভূমখাড়া বিঝারি গ্রামের হিন্দু ও মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয় পাকিস্তান সেনাবাহিনী। স্বজনদের সামনে অসংখ্য হিন্দু সম্প্রদায়ের পুরুষকে গুলি করে হত্যা করা হয় এবং অসংখ্য নারীকে ধর্ষণ করা হয়।
তথ্য সুত্রঃ প্রথম আলো, নাগরিক সংবাদ।
লেখকঃ আবু সাঈদ: কবি, সংগঠক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক
abusayedone@gmail.com
২০১০ সালের মে মাসে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে শরীয়তপুরের কুখ্যাত ৮ জন রাজাকারের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সামাদ তালুকদার। সে মামলায় ২০১৬ সালের ৫ ডিসেম্বর পালং থানার কুখ্যাত রাজাকার সোলায়মান মোল্লা ও ইদ্রিস আলী সরদারের ফাঁসির আদেশ হয়। ফাঁসির আদেশের পর সোলায়মান মোল্যা কারাগারে মারা যান। ইদ্রিস আলী পলাতক রয়েছেন এবং বাকিরা আগেই মারা গেছে।
শরীয়তপুর জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস:
বীরপ্রতীক ও খেতাব প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধা:
- বীর প্রতীক খলিলুর রহমান, ভেদরগঞ্জ।
- শহীদ ডাঃ হুমায়ুন কবির (শহীদ বুদ্ধিজীবি খেতাবধারী মুক্তিযোদ্ধা)
- যোগেশ চন্দ্র ঘোষ (শহীদ বুদ্ধিজীবি খেতাবধারী মুক্তিযোদ্ধা)
- মহিউদ্দিন সরদার (শহীদ মুক্তিযোদ্ধা)
- শরীয়তপুর জেলায় শহীদ মুক্তিযোদ্ধাগণের তালিকা
শরীয়তপুর জেলার বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা:
শরীয়তপুরে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি চিহ্ন
শরীয়তপুর জেলার মুক্তিযুদ্ধ ইতিহাস সম্পর্কিত বইপত্র:
আপনার মতামত দিন