প্রাথমিক পরিচয়: সারা ভারতব্যাপী ফুটবলে যে কয়জন খেলোয়ার অনন্য সাধারণ ভূমিকা রাখেন গোষ্টপাল অন্যতম। তিনি ভারতের প্রথম ফুটবল টীমের অধিনায়ক ছিলেন। বাংলাদেশের বইপত্রে তাকে “গোস্ট পাল আর ভারতের কয়েকটি পত্রিকা তার নাম “ঘোস্ট পাল” লিখে থাকেন।
জন্ম: গোস্ট পালের জন্ম ১৮৯৬ সালের ২০ আগস্ট। তিনি তৎকালীন বাংলাদেশের মাদারীপুর সাব ডিভিশনের ভোজেশ্বর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। তার বাবা শ্রীযুক্ত বাবু শ্যামলাল পাল ছিলেন একজন ব্যবসায়ী।
ফুটবলে বর্ণাঢ্য জীবন:
মাত্র ১১ বছর বয়সে তিনি কলকাতার একটি ক্লাবে খেলার সুযোগ পান। এই বয়সেই তিনি কুমারটুলির হয়ে মাঠে নামেন। ১৯০৭ থেকে ১৯১৩ সাল পর্যন্ত তিনি কলকাতার কুমারটুলি ক্লাবে খেলেছেন। মোহনবাগানের খেলোয়াড় রাজেন সেনের সহায়তায় তিনি ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে মোহনবাগান দলে যোগ দেন। ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে মোহনবাগানের হয়ে তিনি প্রথম খেলেন। এরপর ২৩ বছর ধরে মোহনবাগানের হয়ে খেলেছেন। পরাধীন ভারতে সবুজ-মেরুন রঙের জার্সি গায়ে মোহনবাগান রক্ষণে তার বিক্রমকে ভয় পেত বুট পরা ইংরেজ ফুটবলাররাও।
গোস্ট পাল খেলতেন রাইট ব্যাক পজিশনে। খেলার সময় বুট পরা ইউরোপিয় খেলোয়াড়দের তিন খালি পায়ে খেলে প্রতিরোধ করতেন। ভারতীয় দল নিয়ে ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি সিংহলে (বর্তমান শ্রীলঙ্কা) যান। পরের বছর দক্ষিণ আফ্রিকায় ভারতীয় ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের অধিনায়ক নির্বাচিত হন। পরে তিনি আঘাতের কারণে যেতে পারেন নি। ১৯২৪ সালে ভারতীয় জাতীয় দলেরও অধিনায়কত্ব পান। তিনি হকি খেলাতেও দক্ষ ছিলেন এবং ক্রিকেট এবং টেনিসও খেলতেন। ১৯৩৫ সালে তিনি ফুটবল থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
তাকে বলা হতো চীনের প্রাচীর: শক্ত সার্থক পেশীবহুল গোষ্টপালের মধ্যে যেমন ছিল হারকিউলিসের মত শক্তি, তেমনি বুলটোরিয়ানের মত গোঁ। পল্টনী খেলোয়ারদের বুট এবং খেলার নির্মাণ কৌশল গোস্টর কাছে ভয়ের কোন ব্যাপার ছিল না। ওঁর খেলার বৈশিষ্ট্য ছিল লম্বা কিক, নির্ভয় ট্রাকলিং, ঠান্ডা মাথায় প্রতিপক্ষকে তাড়া করা, বুদ্ধিদীপ্ত ভাবে এবং নিঃশব্দে বল ছিনিয়ে নেয়া।
১৯৮৪ সালে কলকাতায় স্থাপিত হয় তাঁর ভাস্কর্য। খালি পায়ে ফুটবল খেলার ঔদ্ধত্যটাই বোঝানো হয়েছে এই ভাস্কর্যে। সেই ভাস্কর্যের নিচে লেখা আছে, “ভারতীয় ফুটবলে সর্বকালের সেরা ব্যাক। সে যুগে বুটপরা ইউরোপীয় ফুটবলারদের বিরুদ্ধে খালি পায়ে খেলে দুর্ভেদ্য চীনের প্রাচীর নামে খ্যাত। খেলার মাঠে স্বজাতির সম্মান প্রতিষ্ঠায় ও জাতীয়তাবাদের উন্মেষে অন্যতম সৈনিক।”
‘দ্য ইংলিশ ম্যান’ – পত্রিকা তাকে চাইনিজ ওয়াল খেতাব দেয় “Gostha Imapegnable as the Chinese Wall.”। সেই একটা প্রবাদের জনক হল – ‘চাইনিজ ওয়াল’। বাঙালির সম্মানের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকল – গোস্ট পাল – দ্য চাইনিজ ওয়াল।
তার জন্মস্থানকে ভুলেন নি তিনি:
গোস্ট পাল ফুটবল খেলে উপমহাদেশে সেই বিংশ শতাব্দীতে নাম কুড়ালেও কখনোই তার জন্মস্থানকে ভোলেননি। তার আত্মজীবনীতেও তিনি লিখেছেন ‘পূর্ব বঙ্গের ফরিদপুরের মাদারীপুর সাব ডিভিশনের ভোজেস্বর গ্রামে আমার জন্ম হয়, দিনটি ১৮৯৬ সালের ২০শে আগস্ট, দিনের আলো ফুটিবার আগেই আমি ধরিত্রীর মুখ দেখিয়াছিলাম, আমার পিতা সেই সময় ঘরে ছিলেন না, পিতৃদেবের নাম শ্রীযুক্ত বাবু শ্যামলাল পাল, বরিশালের ঝালকাটি বন্দরে তেজারতির কারবার করিতেন, আমি পিতার প্রথম এবং একমাত্র সন্তান’।
সম্মাননা ও স্বীকৃতি:
১৯৬২ সালে ভারত সরকার গোস্ট পালকে ‘পদ্মশ্রী’ উপাধিতে ভূষিত করে। সফর করেন , ১৯৯৮ সালে ভারত সরকার তার নামে ” ডাকটিকিট” প্ৰকাশ করে ৷ তিনিই ছিলেন প্রথম ফুটবলার যার নামে ডাকটিকিট প্রকাশ করা হয় ৷
১৯৮৪ সালে কলকাতায় স্থাপিত হয় তাঁর ভাস্কর্য।
কলকাতার ইডেন গার্ডেন্স ও মোহনবাগান মাঠের সামনে দিয়ে যাওয়া কলকাতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাস্তাটির গোষ্ঠ পাল সরণি। তাঁর স্বরণে ডাকটিকিটও প্রকাশিত হয়েছে। মোহনবাগান ক্লাব ২০০৪ খ্রিস্টাব্দে তাঁকে মরনোত্তর মোহনবাগান রত্ন উপাধিতে ভূষিত করে। মোহনবাগান ক্লাবের ভিতরে তাঁর নামে একটি সংগ্রহশালা গোস্ট পাল সংগ্রহশালা তৈরি হয়েছে। সেন্ট্রাল কলকাতায় রয়েছে গোস্ট পাল মেমোরিয়াল স্পোর্টিং ক্লাব ও চালু হয়েছে “গোষ্ঠ পাল চাম্পিয়ান্স বেবি লিগ”।
মৃত্যুঃ ১৯৭৫ সালের ৮ এপ্রিল তিনি পরলোক গমন করেন।
তথ্যসুত্র: শরীয়তপুর অতীত ও বর্তমান (আবদুর রব শিকদার), রাইসিংবিডি, কালেরকন্ঠ, খবর (কোলকাতা), নিউজ18(কলকাতা), অনলাইন।
আপনার মতামত দিন