ভাষা সৈনিক ডাঃ গোলাম মাওলা

সাধারণ পরিচিতি: ডা. গোলাম মাওলা ছিলেন একাধারে ভাষা সৈনিক, সমাজসেবক, বিশিষ্ট চিকিৎসক ও রাজনীতিক।মাদারীপুরের প্রথম এমবিবিএস ডাক্তার। এছাড়াও ভাষা আন্দোলনে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ডা. গোলাম মাওলাকে একুশে পদক ২০১০ (মরনোত্তর) প্রদান করা হয়।

পারিবারিক জীবন:  পারিবারিক এবং বিভিন্ন গ্রন্থ থেকে জানা গেছে, ডা. গোলাম মাওলা ১৯২০ সালের ২০ অক্টোবর ফরিদপুর জেলার মাদারীপুর মহকুমার নড়িয়া থানার পোড়াগাছা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা হাজী আব্দুল গফুর ঢালী এবং মাতা ছুটু বিবি। ৫ ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। বড় ভাই গোলাম কাদের, তৃতীয় ভাই গোলাম করিম, ছোট ভাই গোলাম জিলানী এবং একমাত্র বোন রাবেয়া খাতুন। নড়িয়ায় জন্মগ্রহণ করলেও তিনি মাদারীপুর শহরে বসবাস করতেন। ডাঃ গোলাম মাওলা ১৯৪৮ সালে সিরাজগঞ্জ শহরের আব্দুল গফুর খানের বড় মেয়ে ফাতেমা খাতুনকে বিয়ে করেন। তাঁর শ্বশুর ছিলেন মজলুম জননেতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী’র ফুফাতো ভাই। বিবাহিত জীবনে তিনি এক ছেলে তিন মেয়ে’র পিতা। তাঁর একমাত্র পুত্র সন্তান ডাঃ গোলাম ফারুক চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিত রয়েছেন।

শিক্ষা জীবন: ডা. গোলাম মাওলা বর্তমান শরীয়তপুর জেলার জাজিরা থানার পাঁচুখার কান্দি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শিক্ষাজীবন শুরু করেন। ১৯৩৯ সালে তিনি নড়িয়া বিহারীলাল উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মেট্রিক, ১৯৪১ সালে জগন্নাথ কলেজ থেকে আইএসসি এবং একই কলেজ থেকে ১৯৪৩ সালে বিএসসি পাস করেন। ডা. গোলাম মাওলা ১৯৪৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভূতত্ত্ববিদ্যায় এমএসসি এবং ১৯৫৪ সালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেন। ১৯৫৬ সাল থেকে তিনি মাদারীপুরে চিকিৎসা পেশায় নিয়োজিত ছিলেন।

রাজনৈতিক জীবন: ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগ গঠন করা হলে ডাঃ গোলাম মাওলা ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা সহ-সভাপতি। কারণ ছাত্রলীগের ইতিহাস বাঙালি জাতির ইতিহাস, ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস, স্বাধীনতার ইতিহাস। তিনি ১৯৪৫-৪৬ সালে কলকাতার মুকুল ফৌজের অধিনায়কের পদ লাভ করেন। ১৯৫২ সালের ৩১ জানুয়ারি গঠিত সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদে ২৩তম সদস্যের পদ লাভ করেন। (জনকন্ঠ)

ভাষা আন্দোলনে অসামান্য ভুমিকা: 
বাংলা ভাষা আন্দোলনে নেতৃস্থানীয় ভাষা সৈনিক তিনি। ২ ফেব্রুয়ারি সংগ্রাম পরিষদের সভায় ১৯৫২ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভাঙার পক্ষে বিপক্ষে ভোট হলে যে চারজন নেতা ১৪৪ ধারা ভাঙার পক্ষে ভোট দেন ডা. গোলাম মাওলা তাঁদের অন্যতম। ২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২’র সন্ধ্যায় আন্দোলন বেগবান করার জন্য তাঁকে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক নির্বাচিত করা হয়।

১৯৫২ সালে ডা. গোলাম মাওলার ভূমিকা ছিলো অত্যন্ত গৌরবোজ্জ্বল। ওই বছর ২৬ জানুয়ারি পল্টন ময়দানে খাজা নাজিমউদ্দিন ঘোষণা দেন “উর্দ্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।” এ ঘোষণার সাথে সাথে ডা. গোলাম মাওলা উত্তেজিত হয়ে বার বার বলেছিলেন ‘এর কড়া জবাব দিতে হবে’। তিনি ছিলেন সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের আহবায়ক এবং কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার নির্মাণের উদ্যোক্তা।

১৯৫২-এর ২১ ফেব্রুয়ারি বৃহষ্পতিবার বেলা ৩টা ১০ মিনিটে ১৪৪ ধারা ভাঙার সময় ছাত্রদের মিছিলে পুলিশ গুলি চালালে শহীদ হন বরকত, সালাম, রফিক, জব্বার। তাদের লাশ রাখা হয় মেডিক্যাল কলেজের ব্যারাকে। ডা. গোলাম মাওলা অদম্য সাহসের সাথে আহতদের দেখাশুনা ও চিকিৎসা করতেন। তিনিই প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।  ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে বাংলা ভাষার জন্য আন্দোলনকারীদের স্তব্ধ করে দিতে যে স্থানটিতে গুলি করা হয়েছিলো ঠিক সে স্থানটিতেই নির্মিত হয় প্রথম শহীদ মিনার।

মানতাবাদী চিকিৎসক:  চিকিৎসক হিসেবে গোলাম মাওলা ছিলেন মানবতাবাদী ও নিবেদিত প্রাণ। গরীব রোগীদের তিনি বিনা পয়সায় চিকিৎসা করতেন। গোলাম মাওলা তাঁর উপার্জিত অর্থের অধিকাংশই ব্যয় করেছেন সংগঠন ও সেবামূলক কাজে।

তার নামে নামকরণ: 
ধানমণ্ডি-১ নম্বর সড়কটি ভাষা সৈনিক গোলাম মাওলার নামে নামকরণ করা হয়েছে। মিরপুর রোড সংলগ্ন এই সড়কের মুখে সাদা মার্বেলের নামফলক থাকলেও নামের ব্যবহার নেই কোনো স্থাপনাতেই।

ধানমন্ডি ১ নম্বর এলাকার সড়কের নামকরণ করা হয়েছিল ভাষাসৈনিক ডা. গোলাম মাওলার নামে।

ভাষাসৈনিক ডা. গোলাম মাওলা নামে শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার মোক্তারের চর ইউনিয়নে একটি সড়ক আছে। ২০০৮ সালে ভাষাসৈনিক ডা. গোলাম মাওলা নামের সড়কটি উদ্বোধন করেন, তৎকালীন শরীয়তপুর-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও সাবেক ডেপুটি স্পিকার কর্ণেল (অবঃ) শওকত আলী।  এছাড়া তার নামে ভাষাসৈনিক ডা. গোলাম মাওলা সরকারি গণগ্রন্থাগার রয়েছে শরীয়তপুরে।

ভাষা সৈনিক ডাঃ গোলাম মাওলা সরকারি গণগ্রন্থাগার, শরীয়তপুর

মাদারীপুরে অনুষ্ঠিত ম্যারাথন প্রতিযোগিতার নাম করা হয় ‘ভাষাসৈনিক ডা. গোলাম মাওলা’ মিনি ম্যারাথন প্রতিযোগিতা। এতে অংশ নেয় কিশোর, বৃদ্ধসহ বিভিন্ন বয়সের মানুষ। সুস্থ জীবন গড়ার লক্ষ্যে দৌড়ের কোনো বিকল্প নেই বলে দাবি অংশগ্রহণকারীদের। আর যুবসমাজের মনোবল চাঙা করা ও আনন্দ দেয়াই মূল উদ্দেশ্য বলে জানায় আয়োজকরা।

দেশের দেশে একটি রোরো ফেরীকে  ‘ভাষা সৈনিক ডা. গোলাম মাওলা’ র নামে নামকরণ করা হয়।

মৃত্যু:ভাষা সৈনিক ডা. গোলাম মাওলা ১৯৬৭ সালের ২৯ মে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন।

মাদারীপুরে তাঁর নিজ বাস ভবনের সামনে তাঁকে কবরস্থ করা হয়।

তথ্যসুত্র:

আপনার মতামত দিন