নড়িয়া সরকারি কলেজ

১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর, অর্জিত হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। নয় মাস সশস্ত্র যুদ্ধের পর অত্র অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধারা নিজ নিজ ঘরে ফিরেলো। তারা নতুন উদ্যমে দেশ গড়ার কাজে নিয়োজিত হলো। তারা উপলব্ধি করলো শিক্ষা ব্যতীত এ জাতি কখনো উন্নতি করতে পারবে না। তাই বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল শওকত আলীর নেতৃত্বে অত্র অঞ্চলের সকল মুক্তিযোদ্ধা ও জনগণ নড়িয়াতে একটি কলেজ করার পরিকল্পনা করলো। তারপর থেকে শুরু হয় কলেজ প্রতিষ্ঠার বাস্তব উদ্যোগ। অত্র অঞ্চলের সর্বস্তরের মানুষ নিয়ে কলেজের সাংগঠনিক কমিটি গঠিত হলো। সাংগঠনিক কমিটি গঠিত হলো। সাংগঠনিক কমিটির আহ্বায়ক হলেন গণপরিষদ সদস্য মরহুম আলী আহমেদ খান।

সাংগঠনিক কমিটির এক সভা মরহুম আলী আহমেদ খানের সভাপতিত্বে ২৮/০৬/১৯৭২ খ্রি. তারিখে অনুষ্ঠিত হয়। ঐ সভায় কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্যে বিভিন্ন সাব-কমিটি গঠন করা হয়। যেমন (১) স্থান নির্বাচন সাব-কমিটি, (২) গৃহ নির্মান সাব-কমিটি, (৩) লজিং সাব-কমিটি, (৪) চাঁদা আদায় সাব-কমিটি, (৫) শিক্ষক কর্মচারী নিয়োগ সাব-কমিটি। ঐ সভায় ডাঃ আবুল কাসেম সাহেবকে আহ্বায়ক করে আলী আহমেদ খান, কর্নেল শওকত আলী, হাজী মমিন আলী বেপারী ও অধ্যক্ষ মোঃ আব্দুল লতিফকে সদস্য করে কলেজের স্থান নির্বাচন সাব কমিটি গঠন করা হয় এবং ছাত্র ভর্তির সিদ্ধান্তও নেয়া হয়। স্থান নির্বাচন সাব-কমিটি ০৯/০৭/১৯৭২ খ্রি. তারিখে নড়িয়া হেডকোয়ার্টারে কলেজের স্থান নির্বাচন করেন। কলেজ স্থাপনের জন্যে মোক্তারের চর নিবাসী মরহুম আব্দুল লতিফ বন্দুকছির কাছ থেকে ৮.২৫ একর জমি নামমাত্র মূল্যে গ্রহণ করেন। কলেজটি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে জনাব আব্দুল লতিফ বন্দুকছির অবদান খুবই প্রশংসনীয়।

সাংগঠনিক কমিটির আরেক সভা ০৫/১০/১৯৭২ খ্রি. তারিখে অনুষ্ঠিত হয়। এ সভায় শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ অনুমোদন দেয়া হয়। নিয়োগপ্রাপ্তরা হলেন

 

১) জনাব মোঃ আব্দুল  লতিফ ,             অধ্যক্ষ

২) জনাব বিনয় কৃষ্ণ কুন্ডু                   প্রভাষক, বাংলা

৩) জনাব মোঃ আব্দুল হক                  প্রভাষক, অর্থনীতি

৪) জনাব উম্মিয়া খাতুন                      প্রভাষক, যুক্তিবিদ্যা

৫) জনাব রওশন আলী                        প্রভাষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান

৬) জনাব আলতাফ হোসেন মোল্লা     প্রভাষক, বাণিজ্য

৭) জনাব আলী আশরাফ                     টিউটর, ইংরেজী

৮) জনাব হাছিন খান                         অফিস সহকারী

৯) নান্নু মিয়া                                      পিয়ন

১০) আফাজদ্দিন                                নাইট গার্ড

কলেজের উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে কলা ও বাণিজ্য বিভাগের কার্যক্রম এবং কলেজের ক্লাস অস্থায়ীভাবে প্রথম শুরু হয় নড়িয়া বি.এল. উচ্চ বিদ্যালয়ে।

নড়িয়া মহাবিদ্যালয় ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন

৩০ জুলাই, ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে নড়িয়া মহাবিদ্যালয়ের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন নড়িয়া থানার অন্তর্গত সালধ গ্রামের হাজী রিয়াজউদ্দিন রাঢ়ী যিনি এই থানার অসীম সাহসী বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ সিপাহী আব্দুল মান্নান রাঢ়ীর পিতা। শহীদ সিপাহী আব্দুল মান্নান রাঢ়ী (নং ৫১৮৮) সাবেক ই.পি.আর থেকে বাংলাদেশে স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগ দেন এবং পালং থানা অপারেশনে ২০/০৯/১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে পাকবাহিনীর গুলিতে মৃত্যু বরণ করেন।

কলেজটি প্রতিষ্ঠার জন্যে মূলত বিভিন্ন সংস্থা, ব্যক্তিবর্গ ও প্রতিষ্ঠান বিভিন্নভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন। স্থানীয়ভাবে এম আর অফিস, ইউনিয়ন পরিষদ, লঞ্চঘাট, নিকাহ রেজিস্ট্রার অফিস, রেশন ডিলারের কাছ থেকে বেশ ভালো অনুদান এসেছে কলেজে। ঢাকা থেকে কর্নেল শওকত আলীসহ মুক্তিযোদ্ধা ও গন্যমান্য ব্যক্তিবর্গ হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে কলেজের জন্য অর্থ সংগ্রহ করেছেন। কর্নেল শওকত আলীর তত্ত্বাবধানে কলেজটি বোর্ড স্বীকৃতি পায় এবং দু’টি পাকা ভবন নির্মিত হয় যা কলেজের মূল ভবন হিসেবে পরিচিত।

প্রথম অধ্যক্ষ জনাব মোঃ আব্দুল লতিফ ০১/০৭/১৯৭২ খ্রি. থেকে ৩১/০৩/১৯৭৫ খ্রি. পর্যন্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। তারপর জনাব মোঃ রওশন আলী ০৪/০৫/১৯৭৫ খ্রি. থেকে ০৪/১০/১৯৮১ খ্রি. পর্যন্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। তারপর ০৪/০৮/১৯৮১ খ্রি. থেকে অর্থনীতি বিষয়ের উদ্যোগী, কঠোর পরিশ্রমী ব্যক্তিত্ব সুলতান মাহমুদ সীমন এর উপর অধ্যক্ষের দায়িত্ব অর্পিত হয়। তিনি কর্নেল শওকত আলীর পরামর্শ, সহযোগিতা নিয়ে ১৯৮২-৮৩ শিক্ষাবর্ষে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে বিজ্ঞান বিভাগ চালু করেন। তিনি ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দে কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা কেন্দ্রও চালু করেন। তখন ১৯৮৪-১৯৮৫ শিক্ষাবর্ষে ডিগ্রীর ছাত্র-ছাত্রী পূর্ব মাদারীপুর কলেজে পরীক্ষা দেয়। ১৯৮৬-৮৭ শিক্ষাবর্ষ থেকে নড়িয়া কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বীকৃতি পায় এবং ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দে নড়িয়া কলেজ ডিগ্রী পরীক্ষা কেন্দ্র হিসেবে অনুমোদন পায়।

১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দে ২০ সেপ্টেম্বর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুসেন মুহাম্মদ এরশাদ নড়িয়া কলেজকে জাতীয়করণের অঙ্গীকার করেন। ২৩/০৩/১৯৮৮ খ্রি. থেকে কলেজটির নাম নড়িয়া সরকারি কলেজ হিসেবে বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে সরকারি গেজেটে প্রকাশিত হয়। কলেজটির সরকারিকরণে নড়িয়ার বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব টি.এম. গিয়াস উদ্দিন, সাবেক মন্ত্রী সাহেবের বিশেষ অবদান আছে। কলেজের তৎকালীন কিছুসংখ্যক ছাত্রনেতা মিছিল মিটিং করে কলেজটি সরকারিকরণে যথেষ্ট সহযোগিতা করেছেন।

সরকারিকরণের পর ১৯৮৮ খ্রি. থেকে ১৯৯৭ পর্যন্ত ছিলো কলেজের যৌবনকাল। এ সময়ে শিক্ষক-কর্মচারীর সংখ্যা ছিলো পর্যাপ্ত এবং ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যাও ছিলো পর্যাপ্ত। কলেজে শিক্ষার পরিবেশ ছিলো ভালো। উচ্চমাধ্যমিক ও স্নাতক শ্রেণিতে ফলাফল ছিল প্রশংসনীয়। তাছাড়া শিক্ষার পাশাপাশি ছাত্র-ছাত্রীদের ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ এবং শারীরিক ও মানবিক বিকাশের বেশ সুযোগ ছিলো। প্রতি বছর কলেজ থেকে স্মরণিকা, কলেজ বার্ষিকী, দেয়াল পত্রিকা বের হয়েছে। এমনকি প্রতি বছর কলেজে নাটক মঞ্চস্থ হতো। এছাড়া কলেজের রোভার-স্কাউট, গার্ল ইন রোভার দলের ভূমিকা ছিলো উল্লেখযোগ্য।

২০০১ খ্রিস্টাব্দে থেকে কলেজটি বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত হয়ে পড়ে। প্রমোশন নিয়ে অভিজ্ঞ শিক্ষকবৃন্দ প্রভাষক থেকে সহকারি অধ্যাপক হয়ে অন্যত্র চলে যান। অপরদিকে পি.এস.সি কতৃক বি.সি.এস. এর মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগের সংখ্যা ছিলো খুব কম। এ সমস্যা ২০০৫ খ্রি. পর্যন্ত ছিলো। ২০০৩ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বরে ২২তম বিসিএস এবং ২০০৫ খ্রিস্টাব্দে ২৪তম বিসিএস এর মাধ্যমে কলেজের শিক্ষক সমস্যা দূর হয়। ফলে এ বছর থেকে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে তেমনি কলেজের ফলাফলও ঈর্ষণীয়রূপে ভালো হচ্ছে।

আর ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষে মহান জাতীয় সংসদের তৎকালীন ডেপুটি স্পিকার কর্নেল (অব.) শওকত আলী এমপির আন্তরিক প্রচেষ্টায় কলেজটি বাংলা ও মার্কেটিং কোর্স চালু করতে সক্ষম হয়।

 

                                   এক নজরে কলেজের উত্তরণের  ধাপসমূহঃ

 

    • জুলাই ১৯৭২ কলেজ প্রতিষ্ঠা, উচ্চ মাধ্যমিক মানবিক ও বাণিজ্য শাখার মাধ্যমে ক্লাশ চালু
    • জুলাই ১৯৮২ উচ্চ মাধ্যমিক বিজ্ঞান শাখার প্রবর্তন
    • জুলাই ১৯৮৬ উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা কেন্দ্রের অনুমতি
    • মার্চ ১৯৮৮ কলেজ সরকারিকরণ
    • ২০১২-২০১৩ বাংলা ও মার্কেটিং বিষয়ের অনার্স চালু
    • ২০১৪-২০১৫ হিসাববিজ্ঞান বিষয়ের অনার্স চালু
    • এপ্রিল ২০১৫ ডায়নামিক ওয়েবসাইট চালু

————————————————————————————————————————–
সূত্র ঃ

  • উদয়-২০১৫, নড়িয়া সরকারি কলেজের বার্ষিক ম্যাগাজিন ২০১৫ ও
  • কলেজের ওয়েবসাইট (http://nariagovtcollege.edu.bd)
    তথ্য হালনাগাদের তারিখ: ৩০ মে ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দ।

 

আপনার মতামত দিন