১০ ডিসেম্বর শরীয়তপুর হানাদার মুক্ত দিবস

মধ্যপাড়া স্মৃতিস্তম্ভ: স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ১৯৭১ সালের ২২ মে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বর্তমান শরীয়তপুর জেলার পালং থানার অন্তগর্ত মধ্যপাড়া নামক স্থানে নির্মম হত্যাকান্ড চালায়। এছাড়াও আঙ্গারিয়া, কাশাভোগ পশ্চিম কাশাভোগ, নীলকান্দি, মনোহর বাজার, রুদ্রকর, ধানুকা নামক এলাকাগুলোতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নির্বিচারে অগ্নিসংযোগ, ধর্ষন, লুন্ঠন সহ নানাবিধ অপরাধে লিপ্ত হয়। এ গণহত্যায় নিহতদের আত্নত্যাগের স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য মধ্যপাড়ায় একটি স্মৃতি স্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। শরীয়তপুর জেলার বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ, সদর পৌরসভার সাবেক মেয়র বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রব মুন্সি ২০১০ সালে এই স্মৃতিস্তম্ভ নির্মান করেন।  তথ্য সুত্র: জেলা ব্রান্ডিং প্রকাশনা (শরীয়তপুর জেলা প্রশাসন)।

১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মুক্তি ও মিত্রবাহিনীর যৌথ আক্রমণে হানাদারমুক্ত হয়েছিল শরীয়তপুরের বিভিন্ন অঞ্চল। যদিও বর্তমান শরীয়তপুর জেলা মুক্ত হয় ১৫ অক্টোবর কিন্তু আজকের শরীয়তপুর জেলা মুক্তিযুদ্ধের সময় মাদারীপুর মহাকুমার অর্ন্তগত থাকায় মাদারীপুরের সঙ্গে মিল রেখে ১০ ডিসেম্বর শরীয়তপুর মুক্তদিবস পালন করা হয়।

জেলা মুক্তিযোদ্ধা ইউনিট কমান্ডার আব্দুস সাত্তার খান, ডেপুটি কমান্ডার আব্দুর রাজ্জাক সরদার, সদর উপজলা ইউনিট কমান্ডার আব্দুল আজিজ সিকদার ও শরীয়তপুরের যুদ্ধাপরাধ মামলার বাদী মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সামাদ তালুকদারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে- আজকের শরীয়তপুর জেলা মুক্তিযুদ্ধের সময় ছিলো মাদারীপুর মহাকুমার অর্ন্তগত।

ভেদেরগঞ্জ, নড়িয়া, গোসাইরহাট, জাজিরা ও পালং থানা নিয়ে মাদারীপুর মহাকুমার এ অঞ্চলকে বলা হতো পূর্ব মাদারীপুর।

যা পরবর্তীতে ১৯৭৮ সালে এ অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় আর একটি মহাকুমা। ফরায়েজী আন্দোলনের প্রবাদ পুরুষ হাজী শরীয়তুল্ল্যাহর নামানুসারে এ নবগঠিত মহকুমাটির নামকরণ করা হয় শরীয়তপুর।
১৯৮৬ সালে দেশের সব মহাকুমাকে জেলায় উন্নীত করার প্রক্রিয়ায় প্রশাসনিক কার্যক্রম শুরু হয় শরীয়তপুর জেলায়।

মুক্তিযুদ্ধের সময় মাদারীপুর মহকুমা মুক্ত হয় ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর। কিন্তু পূর্ব মাদারীপুর অঞ্চল অর্থাৎ বর্তমান শরীয়তপুর জেলা মুক্ত হয় ১৫ অক্টোবর। ১৫ অক্টোবরের পর শরীয়তপুর জেলা অর্থাৎ তৎকালীন পূর্ব মাদারীপুর অঞ্চলে হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার, আলবদর, আলসামসদের কোনো উপস্থিতি বা কার্যক্রম ছিল না। পালং থানা হানাদারমুক্ত হয় ৪ ডিসেম্বর ও নড়িয়া থানামুক্ত হয় ২৩ জুন’ ১৯৭১। কিন্তু আজকের শরীয়তপুর জেলা মুক্তিযুদ্ধের সময় মাদারীপুর মহাকুমার অর্ন্তগত থাকায় মাদারীপুরের সঙ্গে মিল রেখে ১০ ডিসেম্বর শরীয়তপুর মুক্ত দিবস পালন করা হয়।

মাদারীপুর মহকুমার তৎকালীন জাতীয় পরিষদের সদস্য ডা. আবুল কাশেম, অ্যাডভোকেট আবিদুর রেজা খান, ফনিভূষন মজুমদার, হাসমত আলী খান, প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য আব্দুর রাজ্জাক, আলী আহাম্মদ খান ও আমিনুল ইসলাম দানেশ একটি সভায় মাদারীপুর মহাকুমাকে মুক্তিবাহিনীর হেডকোয়ার্টার হিসেবে ঘোষণা করেন। এ হেডকোয়ার্টারে কর্নেল (অব.) শওকত আলী (তৎকালীন ক্যাপ্টেন) মুক্তিবাহিনীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধে কৃতিত্বের জন্য সরকার তাকে পরবর্তীতে বীরবিক্রম খেতাব দেয়। এ সময় তার সহযোগী হিসেবে স্টুয়ার্ড মুজিবকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। মাদারীপুর মহকুমাকে যুদ্ধের কৌশল হিসেবে মাদারীপুর ও পূর্ব মাদারীপুর দুই ভাগে ভাগ করা হয়।

মে মাসের ২২-২৩ তারিখে রাজাকার, আলবদর, আলসামসদের সহযোগিতায় হানাদার বাহিনী এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় গণহত্যা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটায় সদর থানার মধ্যপাড়া গ্রামে।

মধ্যপাড়া ও আশপাশের এলাকার শিশু, নারী, পুরুষ মিলে ৩৭৪ জনকে হত্যা করে হানাদার বাহিনী। এদের অধিকাংশই ছিলো হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ।

এছাড়া মধ্যপাড়ার শতাধিক নারী পুরুষকে অস্ত্রের মুখে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় মাদারীপুর এ আর হাওলাদার জুট মিলে। সেখানে নারীদের ধর্ষণ ও পুরুষদের গুলি করে হত্যা করে মরদেহ নদীতে ফেলে দেওয়া হয়।

মুক্তিযুদ্ধে স্মৃতিফলক হিসেবে মধ্যপাড়ায় বধ্যভূমিতে কোনো মতে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। তাতে মাত্র ৮১ জন শহীদের নাম উঠে এসেছে যারা এলাকার মানুষ ছিলেন। কিন্তু বিভিন্ন এলাকা থেকে আশ্রয় নিতে আসা অসংখ্য হিন্দু নারী-পুরুষ হত্যা ও ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন তাদের কোনো তালিকা নেই।

এছাড়া সদর থানার উত্তর দক্ষিণ মধ্যাপাড়া, মালো পাড়া, ঝালো পাড়া, কাশাভোগ, নীলকান্দি, আংগারিয়া বাজার, ধানুকা, পাল বাড়ি, কোটাপাড়া বাজার, নড়িয়া থানার গোলার বাজার, তেলিপাড়া, ভূমখাড়া বিঝারি গ্রামের হিন্দু ও মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়িঘর আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দেয় হানাদার বাহিনী। স্বজনদের সামনে অসংখ্য হিন্দু সম্প্রদায়ের পুরুষদের গুলি করে হত্যা করা হয় এবং অসংখ্য নারীদের ধর্ষণ করা হয়।

জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে ভেদরগঞ্জের মহিষারে ২ শতাধিক হানাদার ও তাদের দোষরদের সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর সম্মুখ যুদ্ধ হয়। এতে ১১ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। তাদের গ্রুপ কমান্ডার ছিলেন আক্কাছ মিয়া। মহিষারেই ওই ১১জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধাকে গণকবর দেওয়া হয়।

রাজাকারের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত পালং থানায় মুক্তিযোদ্ধারা ২৮ নভেম্বর গভীর রাতে অপারেশন চালায়। এ অপারেশনে দু’জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং অসংখ্য হানাদার ও তাদের দোসর রাজাকার মারা যায়। এই থানা অপারেশনে নেতৃত্ব দেন মুক্তিযোদ্ধা মাস্টার ইদ্রিস আলী, আবুল কাসেম মৃধা ও মুক্তিযোদ্ধা আলী আজম সিকদার।

১৮ জুলাই ডামুড্যা দামুদর নদীতে একটি লঞ্চে করে পাক হানাদাররা এসে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর হামলা চালালে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটে শক্তি সঞ্চয় করে পাল্টা হামলা চালায়। এতে হানাদার বাহিনীর সদস্যরা পানিতে ডুবে মারা যায়।

ডামুড্যা, ভেদরগঞ্জ, গোসাইরহাট থানায় যুদ্ধের নেতৃত্ব দেন মুক্তিযোদ্ধা আ. মান্নান রাঢ়ী ও ইকবাল হোসেন বাচ্চু।

নড়িয়া থানার মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেন, মুক্তিযোদ্ধা ইউনুস আলী মিতালী, মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী, মুক্তিযোদ্ধা হাসান আলী।

জাজিরায় মুক্তিযুদ্ধকালীন কমান্ডার ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রহমান ও মুক্তিযোদ্ধা ফজলুর রহমান।

তথ্যসুত্র (তথ্য ও ছবি) : বাংলানিউজ 24

আপনার মতামত দিন