অমৃত লাল দে

(স্বাধীনতাত্তোর বরিশালের ক্ষণজন্মা ব্যক্তিত্ব, দানবীর, সমাজসেবী,শিক্ষানুরাগী)

‘কর্মই ধর্ম’ অমৃত লাল দে।

ধর্ম ও কর্মের সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে যিনি সকল মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায় স্থান পেয়েছেন তিনি দানবীর অমৃত লাল দে।
স্বাধীনতাত্তোর বরিশালের ক্ষণজন্মা ব্যক্তিত্ব। তিনি দানবীর, সমাজসেবী, শিক্ষানুরাগী, মানব প্রেমিক হিসেবে পরিচিত। অকাতরে দানের মধ্য দিয়ে তিনি সকল সম্প্রদায়ের মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালবাসা অর্জন করেছিলেন। অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উন্নতির জন্য দিয়েছেন আর্থিক অনুদান।
জন্ম ও পরিচয়ঃ ১৩৩১বঙ্গাব্দের ১৩ই আষাঢ় (২৭ জুন, ১৯২৪) বর্তমান শরীয়তপুর জেলার আঙ্গারিয়া গ্রামে তাঁর জন্ম। তাঁর পিতা রাসমোহন দে এবং মা সারদা দেবী।শিক্ষা জীবনঃ

অত্যন্ত সাধারণ এক পরিবারে তার জন্ম। শৈশব ও কৈশোর কাটে অত্যন্ত কষ্টের মধ্যে। মানুষের প্রধান আয় ছিল চাষাবাদ, মাছ ধরা এবং ছাতা সেলাইয়ের কাজ। অমৃত লাল দে’র পিতা শীতলপাটি বুননের কাজ করতেন। পড়াশুনার প্রতি ভীষণ আগ্রহ ছিল শিশু অমৃত লাল দে’র। নৌকায় বিল পাড়ি দিয়ে গ্রামের পাঠশালায় পড়াশুনা করতেন, কিন্তু পিতা অসুস্থ হয়ে পড়ায় তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ার সময়ই অভাবের তাড়ণায় পড়াশুনা ছাড়তে হয় তাকে।কর্মজীবন:

বাবার অসুস্থতার কারেন নামতে হয় কঠিন জীবন সংগ্রামে। মাত্র ১৫ বছর বয়সে তিনি একটি বিড়ির কারখানায় কাজ শুরু করেন। গভীর রাত পর্যন্ত কাজ করতে হত তাকে। প্রতিদিন ২/৩ মাইল হেটে কর্মস্থলে যেতেন। ১৩৫০ সালে দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে, চারদিকে হাহাকার, বুভুক্ষ মানুষের কান্না, গ্রামে কাজ নেই। এর মধ্যেই অমৃত লাল সিদ্ধান্ত নিলেন বরিশাল শহরে যাবেন। বরিশাল এসে কাজ নিলেন কালীবাড়ী রোডের একটি বিড়ির কারখানায়। এভাবেই অভাবের সাথে যুদ্ধ করে পিতা, মাতা, ভাই-বোনের সংসার চালাতে থাকেন অমৃত লাল দে। সততা ও একাগ্রতার সাথে কাজ করতে করতে জীবনে আসতে থাকে সাফল্য। ২৪ বছর বয়সে তিনি ওই বিড়ির কারখানার ম্যানেজার হন। ১৩৫৪ সালে মাত্র বারো টাকা পুঁজি নিয়ে বিড়ি তৈরির কাজ শুরু করেন। ধীরে ধীরে তাদের বিড়ির চাহিদা বাড়তে থাকে। নতুন বিড়ির নাম দেন ‘কারিকর বিড়ি’।

শুরু হল দোকানে দোকানে সরবরাহ করা। ব্যবসা দিন দিন বৃদ্ধি পেতে লাগল। কারখানায় কারিগর রাখা হয়। কারিকর বিড়ির সুনাম ছড়িয়ে পড়ল শহরে, বন্দরে, গ্রামে। আর পিছে ফিরে তাকাতে হয়নি অমৃত লাল দে’কে। পরিশ্রম, নিষ্ঠা, একাগ্রতা দিয়ে অভাবকে তিনি জয় করলেন। এল সাফল্য।মানুষের সেবায় :

১৩৫০ এর দুর্ভিক্ষে অভাবী মানুষের হাহাকার তাকে করে তুলল মানবপ্রেমী, নিজের শৈশব থেকে তিনি বুঝতেন মানুষের কষ্টের কথা। কন্যাদায়গ্রস্থ পিতা, টাকার অভাবে ফর্ম ফিলাপ করতে না পারা ছাত্র কেউই ফেরেনি এই মানবপ্রেমীর কাছ থেকে। তাই তো তিনি অমৃত। জীবনে সাফল্যের শিকায় পৌঁছালেন তিনি। ভাইদের পড়াশোনা শেখালেন কিন্তু জীবনের কঠিন বাস্তবতা তাকে উপলব্ধি করতে শেখাল মানুষের সেবাই পরম ধর্ম। দান করেছেন মানুষের জন্য, সমাজের জন্য। বরিশাল অঞ্চলের সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষা, খেলাধুলাসহ প্রতিটি ক্ষেত্রেই রয়েছে তার আন্তরিক সহযোগিতা।

প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান : ছোট বেলায় অর্থাভাবে পড়াশুনা না করতে পাড়া অমৃত লাল প্রতিষ্ঠিত হয়ে হয়ে উঠলেন শিক্ষানুরাগী ।

১৯৯২ সালে তিনি অমৃত লাল দে মহাবিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা, অশ্বিনী কুমার হলের সংস্কারক, বরিশাল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার নির্মাণে আর্থিক সহায়তা দান, বরিশাল রামকৃষ্ণ মিশনে চানু স্মৃতি দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপন, সারদা ভবন, সারদা ঘাটলা নির্মাণ, মমতাজ মজিদুন্নেছা বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন, জগদীশ স্বরস্বতি বালিকা বিদ্যালয়ের অমৃত ভবন ও যোগমায়া ভবন নির্মাণ, কাউনিয়া উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় নির্মাণে আর্থিক সহায়তা, বরিশাল পাবলিক লাইব্রেরী নতুন ভবন নির্মাণে আর্থিক সহায়তা, মুকুলস্মৃতি প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্মাণে সহায়তা, বরিশাল ক্লাবে বরিশাল অডিটোরিয়াম নির্মাণ, সাহেবগঞ্জ নাজমুল করিম উচ্চ বিদ্যালয়ের ভবন নির্মাণে আর্থিক সহায়তা, অমৃত লাল দে কিন্ডারগার্টেন প্রতিষ্ঠাসহ অসংখ্য শিক্ষা, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও জনকল্যাণমূলক সংগঠন ও সংস্থায় মহতী কীর্তির স্বাক্ষর রেখে গেছেন। দান করেছেন বিভিন্ন মন্দির, মসজিদ, মাদ্রাসায়।

ক্রীড়া ক্ষেত্রে অবদান: তারই অর্থে বরিশালে শুরু হয় ‘চানু স্মৃতি ক্রিকেট টুর্নামেন্ট’। যেখানে শ্রীলংকার সাবেক অধিনায়ক অর্জুনা রানাতুঙ্গাসহ শ্রীলংকা ও দেশের জাতীয় দলের বহু খেলোয়াড় খেলতে এসেছেন।

সাহিত্য ক্ষেত্রে অবদান: এছাড়াও ‘বরিশালের লোকসাহিত্য’, ‘অশ্বিনী কুমার রচনা সমগ্র’, ‘আচার্য জগদীশ কথামৃত’, ‘বরিশাল ধর্মরক্ষিণী সভা কামিনী সুন্দরী চতুষ্পাঠী ঃ ইতিহাস ও বিকাশ’, ‘বাখরগঞ্জ জেলার ইতিহাস’ প্রভৃতি গ্রন্থের তিনি প্রকাশক।

শরীয়তপুর জেলায় তার অবদান: শরীয়তপুর জেলার নড়িয়া উপজেলার ডিঙ্গামানিক ইউনিয়ন এর রামঠাকুর এর আশ্রমেো তিনি অর্থদান করেছেন।

মৃত্যু: ১৯৯৩ সালের ১৪ জুন ক্ষণজন্মা এই মানুষটি হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ইহলোক ত্যাগ করেন। অমৃত লাল দে মহাবিদ্যালয় প্রাঙ্গনেই তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়েছে। অসামান্য কীর্তির মাঝে তিনি অমর হয়ে সর্বদা তাড়িত করছেন আমাদের বিবেককে। তিনি চিরদিন মানুষের অন্তরে বেঁচে থাকবেন।

আরো জানতে: http://www.barisaltoday.com/2392, http://www.voiceofbarisal.com/23804.aspx

সুত্র: বরিশাল জেলার অনলাইন পত্রিকা।

আপনার মতামত দিন