সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ রথীন্দ্রকান্ত ঘটক চৌধুরীর জন্ম ১৯২১ সালের ২৬ ডিসেম্বর শরীয়তপুর জেলার দক্ষিণ বালুচর গ্রামে। কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সান্নিধ্য পাওয়াটা ভাগ্যের ব্যপার। সেই কবি গুরুর সান্নিধ্য পেয়েছিলেন আমাদের কবি রথীন্ত্রকান্ত ঘটক চৌধুরী। শান্তিনিকেতনে পড়াকালে কবিগুরুর সান্নিধ্যে এসে যেমন নিজের জ্ঞাণ ভান্ডার সমৃদ্ধ করেছেন তেমনি শান্তিনিকেতনের শিক্ষায় প্রভাবিত হয়ে কবিতা, প্রবন্ধ লিখে সমৃদ্ধ করে গেছেন শরীয়তপুর জেলার সাহিত্য ভান্ডারকে।
বিখ্যাত সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদ রথীন্দ্রকান্ত ঘটক চৌধুরী ১৯২১ সালের ২৬ শে ডিসেম্বর (বাংলা ১১ পৌষ ১৩২৮) শরীয়তপুর জেলার পালং থানার দক্ষিণ বালুচর গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। তার পিতার নাম সূর্যকান্ত ঘটক চৌধুরী ও মাতার নাম রত্নাবালা দেবী। সূর্যকান্ত ঘটক চৌধুরী ছিলেন ঐ অঞ্চলের জমিদার। তার ছিল দশ সন্তান (রবীন্দ্রকান্ত, মঙ্গলা, রথীন্দ্রকান্ত, ঊষা, উজ্জলা, কমলা, বেলা, রমেন্দ্র, গীতা, দীপেন্দ্র)। তাদের মধ্যে রথীন্দ্রকান্ত ঘটক চৌধুরী ছিল তৃতীয়। রথীন্দ্রকান্ত ঘটক চৌধুরীর দাদা (সূর্যকান্ত ঘটক চৌধুরীর বাবা) রজনীকান্ত ঘটক চৌধুরী ছিলেন পালং এর বিখ্যাত জমিদার এবং তার পেশা ছিল ওকালতি। তবে রজনীকান্তের পূর্বের বাড়ি ছিল জেলার নড়িয়া উপজেলার রাজনগরে। পরবর্তীতে তারা বর্তমান পালং উপজেলার বালুচর গ্রামে স্থায়ী নিবাস গড়েন। সে সময় বালুচর গ্রাম ছিল ঢাকা জেলার কলাগাছিয়া থানার অন্তর্গত।

রথীন্দ্রকান্ত ঘটক চৌধুরীর শিক্ষা জীবন শুরু হয় তুলাসার গুরুদাস উচ্চ ইংরেজী বিদ্যালয় থেকে। ১৯৩৯ সালে তিনি এ বিদ্যালয় থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করেন। এ বিদ্যালয়ে তিনি শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, লেখক ও কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘অরণি’ ও ‘অগ্রণী’ পত্রিকার সম্পাদক স্বর্ণকমল ভট্টাচার্যকে। প্রবেশিকা পাশ করার পর বাংলা ১৩৪৪ সালে তিনি ভর্তি হন শান্তিনিকেতনে। শান্তিনিকেতনে পড়া শেষে ১৯৪১ সালে রথীন্দ্রকান্ত ভর্তি হন কলকাতার বিদ্যাসাগর কলেজে বি.এ. ক্লাসে। তবে তিনি সেখানে বি.এ. পরীক্ষা দেওয়া হয়নি । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কলকাতায় ব্যাপক বোমাবাজি হলে তিনি বাধ্য হয়েই দেশে ফিরে আসেন।

রথীন্দ্রকান্ত ঘটক চৌধুরীর বাবা ও দাদা সবাই ছিল শিক্ষিত ও সাংস্কৃতিমনা। তাদের বাড়িতেই লাইব্রেরী ছিল । তার বাবা সূর্যকান্ত ঘটক চৌধুরী সারা জীবন তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন বিশাল এক বই ভাণ্ডার। সেখানে সংরক্ষিত ছিল বাংলা ও ইংরেজি ভাষার বই ও দুর্লভ পত্র-পত্রিকা। তাই ছেলেবেলা থেকেই তিনি পড়তেন এসব বইপত্র। এছাড়া তার বড় ভাই রবীন্দ্রকান্ত ঘটক চৌধুরী পড়তেন শান্তিনিকেতনে। আর সেই সুবাদে তিনি ভাইয়ের কাছে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে শুনতেন এবং তার বই খুব সহজেই পেতেন। আর এ থেকেই সাহিত্যের প্রতি তাঁর আগ্রহ আরও বেড়ে যায়।

রথীন্দ্রকান্ত ঘটক চৌধুরীর পরিবারের সবাই ছিল কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভক্ত। ১৯৬১ সালে ঢাকা শহরে রবীন্দ্র শতবার্ষিকী অনুষ্ঠান আয়োজনে রথীন্দ্রনাথের বাবা মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। তার বড় ভাই রবীন্দ্রঘটক চৌধুরী ১৯৩৭ সালের জুলাই মাসে শান্তিনিকেতনে ভর্তি হন। সেখানে তার ঘনিষ্ট সহপাঠিনী ছিল ভারতের সাবেক প্রধান মন্ত্রী ইন্দ্রিরা গান্ধী। রবীন্দ্রঘটক চৌধুরীর সাথে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে ভাল সম্পর্ক ছিল । সেখানে তিনি ছিলেন নাট্য সম্পাদক। রথীন্দ্রঘটক চৌধুরী তুলাসার গুরুদাস উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ার সময় কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে চিঠি লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত কবিতা ‘এবার ফিরাও মোরে’ এ ব্যবহৃত ‘ হৃৎপিণ্ড’ শব্দটির মাত্রা সম্পর্কে সন্দেহ নিয়ে। আর এ চিঠির উত্তর দিয়েছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। ১৯৩৯ সালের ২রা আগস্ট (বাংলা ১৩৪৬ সালের ১৭ শ্রাবন) রথীন্দ্রঘটক চৌধুরীও ভর্তি হয়েছিলেন শান্তিনিকেতনে। সেখানে তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গ পেয়েছিলেন। ১৯৪১ সালে তিনি শান্তিনিকেতনে পড়া শেষে দেশে ফিরেন। বিদায় বেলা তাকে বিদায় জানিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং বলেছিলেন ‘আবার এসো’। তবে সে দেখাই ছিল রবীন্দ্রনাথের সাথে তার শেষ দেখা।

কলকাতা থেকে বাড়ি ফিরে বসে থাকেননি রথীন্দ্রকান্ত ঘটক চৌধুরী। তিনি জড়িয়ে পড়েছিলেন সমাজ সেবা ও রাজনীতিতে। তবে ছাত্র জীবন থেকেই তার ছিল রাজনীতিতে হাতেখড়ি। ছাত্র অবস্থায় তিনি জড়িয়ে পড়ছিলেন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে। রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক চেতনা বিনির্মানে মার্কসবাদ ও সমাজতান্ত্রিক দর্শন ও আদর্শের সক্রিয় কর্মী ছিলেন রথীন্দ্রকান্ত ঘটক চৌধুরী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দেশে মহামারী শুরু হয়। চালের দাম বেড়ে মনে ৩০ টাকা হয়ে যায়। চালের দাম কমানোর দাবিতে রথীন্দ্রনাথ বড় ধরনের মিছিল ও মহাসমাবেশের ডাক দেন। তার এ চাপে স্থানীয় প্রশাসন চালের দাম কমিয়ে নির্ধারণ করেন ১৫ টাকা এবং বিক্রয় হয় রথীন্দ্রনাথের স্লিপের মাধ্যমে। ১৯৪৩ সালের দিকে অনেক লোক খাদ্যাভাবে মারা গেলে তার নেতৃত্বে স্থানীয় খাদ্য বিভাগ ও সার্কেল অফিসারের কাছে ‘চরমপত্র’ দেয়া হয়। তাদের চাপের মুখে প্রশাসন সেখানে একটি লঙ্গরখানা খোলেন।

১৯৪৩ সালে সিরঙ্গলে অনুষ্ঠিত কমিউনিস্ট পার্টির ফরিদপুর জেলার আঞ্চলিক সম্মেলনে রথীন্দ্রকান্ত ঘটক চৌধুরী কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য পদ লাভ করেন। এ পার্টির মূল লক্ষ্য ছিল গরিব ও মেহনতি মানুষের সেবা করা। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের পর এলাকায় অনেক রোগ-বালাইয়ের লক্ষন দেখা দিলে সে রোগ-বালাই প্রতিরোধের জন্য রথীন্দ্রনাথের নেতৃত্বে স্থানীয় প্রশাসনের নিকট একটি অস্থায়ী হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা ও প্রয়োজনীয় ঔষধ সরবরাহের জন্য ডেপুটেশন দেয়া হয়। তাদের দাবী মেনে নিয়ে জেলা স্বাস্থ্য অফিসার সেখানে একটি অস্থায়ী হাসপাতাল স্থাপন করেন। এরপর ভারতের ছাত্র ফেডারেশনের সম্পাদক অন্নদাশংকর ভট্টাচার্য সেখানে পাঞ্জাবী ডাক্তারের একটি টিম পাঠান।

ছাত্র ফেডারেশন (তখনকার কমিউনিস্ট পার্টির ছাত্রগণ সংগঠন), কৃষক সমিতি, ভাষা আন্দোলন, কুমিল্লা সাহিত্য সম্মেলন, তেভাগা আন্দোলন, ফ্যাসিবিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘ, রবীন্দ্র শতবার্ষিক অনুষ্ঠান এবং শেষ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধে উদ্যোগী ভূমিকা গ্রহনের পেছনে রথীন্দ্রকান্ত ঘটক চৌধুরীর রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক চেতনা বিনির্মানে যে দর্শন ও আদর্শ সক্রিয় ছিলো তা মার্কসবাদ ও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অঙ্গিকার। রথীন্দ্রকান্ত ঘটক চৌধুরী কমিউনিস্ট পার্টির একজন সক্রিয় নেতা ছিলেন। পরবর্তী কালে প্রগতি লেখক সংঘেও তিনি যোগ দিয়েছিলেন। উনিশশ’ আশির দশকে তাঁর সম্পাদিত ‘সুকান্তের হস্তাক্ষরে সুকান্তের পাণ্ডুলিপি’ প্রকাশ করে কমিউনিস্ট পার্টির প্রকাশনা সংস্থা ‘জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনী’ যা এক দুর্লভ সংগ্রহ।

রথীন্দ্রকান্ত ঘটক চৌধুরী কৃষকদের খুব ভালবাসতেন। সে সময় তিনি ফরিদপুরের পলদি, পালের চর, কোরফদি কৃষক সম্মেলনে যোগ দেন এবং সেখানে কৃষকদের সাথে বসেই খাওয়া দাওয়া করতেন। ১৯৪৪ সালে মাদারীপুরে অনুষ্ঠিত ফরিদপুর জেলা কমিউনিস্ট পার্টি সম্মেলনে তিনি জেলা সংগঠকের পদে অধিষ্ঠিত হন। ১৯৪৩ সাল থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত তিনি কৃষক, কারিগর ও তাতীদের বিভিন্ন বৈঠকে প্রধান বক্তার ভূমিকা পালন করেন। ১৯৪৫ সাল থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত তিনি তে-ভাগা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এ আন্দোলনে রথীন্দ্রসহ এগারো জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। পরবর্তীতে সবাই এ মামলা থেকে বেকসুর খলাস পান।

১৯৪৭ সালে তুলাসার মাঠে অনুষ্ঠিত তে-ভাগা সম্মেলনে কমরেড শান্তি সেন ও রথীন্দ্রকান্ত ঘটক চৌধুরী বক্তৃতা করেন। সে সময় রথীন্দ্রনাথের আহ্বানে পাঁচ হাজার কৃষক দুহাত তুলে তে-ভাগা আন্দোলনের জন্য শপথ পাঠ করেন। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ভারত দ্বিখণ্ডিত হলে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি রাষ্টের জন্ম হয়। স্বাধীনতা উদযাপন করার জন্য তুলাসার মাঠে একটি জনসভা আহবান করা হয় এবং সে সভায় তিনি ঘোষণা করেন, “আমরা পাকিস্তানকে ভারতের চেয়ে গণতান্ত্রিক, সুখি ও সুন্দর রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলব’’।

১৯৪৮ সালে রথীন্দ্রকান্ত ঘটক চৌধুরীর বাড়িতে পুলিশি তল্লাসী করা হয়।এ সময় তিনি কলকাতা চলে যান এবং কিছুদিন পরে দেশে ফিরে আসেন। তবে ১৯৪৮ সালের ২০ নভেম্বর তিনি আবার কলকাতা চলে যান। সেখানে তিনি অবস্থান করেন ১৯৫০ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত। কলকাতায় অবস্থানকালে তার সঙ্গে পরিচয় হয় তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়, মানিক বন্দোপাধ্যায়, ঋতিক খটক, সমরেশ বসু, মৃনাল সেন, সুকান্ত ভট্টাচার্য সহ অনেক নামকরা কবি সাহিত্যিকের সাথে।

১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে রথীন্দ্রকান্ত ঘটক চৌধুরী স্থানীয়ভাবে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। তিনি সেখানে লোকদের সংগঠিত করে মিটিং মিছিল করতেন। ১৯৭১ সালে ২৫শে মার্চের গণহত্যার পর ২৬শে মার্চ পালং থানায় ‘সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ” গঠন করা হয় এবং রথীন্দ্রকান্ত ঘটক চৌধুরী সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালের ৩১শে মার্চ পালং তুলাসার সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ে রথীন্দ্রনাথের নেতৃত্বে দশ-বারো হাজার লোক সমগম হয় এবং পাকিস্তান বিরোধী শ্লোগান দেয়। সে সময় এ অঞ্চলে প্রথম জাতীয় পাতাকা উত্তোলন করা হয়। আর এ জাতীয় পাতাকা উত্তোলন করেন সমাবেশের সভাপতি রথীন্দ্রকান্ত ঘটক চৌধুরী।

রাজনৈতিক, সামাজিকসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে তার অসামান্য অবদান থাকলেও তার আসল পরিচয় হল তিনি ছিলেন একজন সাহিত্যিক। রথীন্দ্রকান্ত ঘটক চৌধুরীর সাহিত্য চর্চা শুরু করেন স্কুল জীবন থেকেই। বাংলা ১৩৪০ সালের ৩০শে পৌষ মাত্র বারো বছর বয়সে তিনি তার ঢাকার বাড়ির ছাদে লুকিয়ে ‘প্রার্থনা’ নামে একটি কবিতা লেখেন। এটি ছিল তার প্রথম সাহিত্য রচনা । কবিটি নিম্নরূপ-

জানিনা আমি তোমার মহিমা
জানিনা তোমার কোথায় শেষ।
সলিলে, সাগরে স্থলেই তো তুমি
আবার কোথায় সরগে বাস।
কেন আস তুমি কেন যাও আর
সর্বদা থাকিবে ভুবন মাঝার,
….কভু না যাইবে আর।
কেন থাক তুমি গুহার মাঝারে,
হইয়ে পক্ক কেশ
জানিনা তোমার কোথায় শেষ।

১৯৩৯ সালের এপ্রিল মাসে (বাংলা ১৩৪৫ সালের ২৫ থেকে ২৭ চৈত্র) কুমিল্লায় অনুষ্ঠিত ‘কুমিল্লা সাহিত্য সম্মেলন’ এ তিনি যোগদান করেন দক্ষিন বিক্রমপুরের ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে। সেখানে তার সাথে পরিচয় হয় খ্যাতনামা কবি যতীন্দ্রপ্রসাদ ভট্টাচার্য, পড়োখযাট সাহিত্যিক বিভূতিভূষন মুখোপাধ্যায়, সম্মেলনের সভাপতি সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, কাজি আবদুল ওদুদসহ অনেক নামকরা কবি সাহিত্যিকের সাথে।

১৯৪৮ সালের দিকে রথীদ্রকান্ত কয়েকজন বন্ধু মিলে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থের নাম রাখেন ‘পদক্ষেপ’ এবং সেটি তখন কলকাতায় প্রকাশের আয়োজন করা হয়। এর আগে তিনি এ বইয়ের নাম রেখেছিলেন ‘আগুনবোনা’। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল সে বইটি প্রকাশ করা হয় বিশ বছর পর ১৯৬৮ সালে পারিবারিক প্রচেষ্টায়। তবে তখন এ বইয়ের নাম ‘আগুনবোনা’ বা ‘পদক্ষেপ’ কিছুই রাখা হয়নি, বইটির নাম রাখা হয়েছিল ‘পূর্বাপর’। এ বইয়ের ১ম সংস্করণ এখন আর পাওয়া যায় না। তবে ১৯৮৮ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে ‘মুক্তধারা’ থেকে এটির দ্বিতীয় সংস্করণ বের হয়। সপ্তম শ্রেণী থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত অসংখ্য কবিতা লিখলেও ‘পূর্বাপর’ ই হল একমাত্র কাব্যগ্রন্থ।

রথীন্দ্রকান্ত ঘটক চৌধুরী এক সময় ‘অগ্রনী’, ‘অরণী’ ইত্যাদি পত্রিকায় চাকরী ও সম্পাদনার কাজে সহায়তা করতেন। তিনি ১৯৪৯ সালে ‘অভিধারা’ নামে একটি মাসিক পত্রিকার ‘শারদীয়’ সংখ্যার সম্পাদনা করেন। মানিক বন্দোপাধ্যায়ের ‘নেতা’ গল্পটি রথীন্দ্রকান্তের সম্পাদিত ‘অভিধারা’ পত্রিকার বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। ১৯৪৫ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত ফ্যাসীবিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘের অধিবেশনে তিনি ফরিদপুরের প্রতিনিধি হিসেবে যোগদান করেন। সেখানে তার সাথে পরিচয় হয়েছিল মানিক বন্দোপাধ্যায়ের সাথে। পত্রিকায় প্রকাশিত তার প্রথম দুটি রচনা হল ‘বালুচরা সিদ্ধেশ্বরী কালীবারি’(প্রবন্ধ), ‘বাসনা’(কবিতা)। তার এ প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয় ১৯৩৬ সালের ফেব্রুয়ারী-মার্চের ‘জ্ঞানলোক’ পত্রিকায়। তিনি মৃত্যুর আগে ‘সোনার বাংলা গান বিতর্ক’ নামে একটি রচনা লিখেছিলেন যা প্রকাশিত হয়েছিলো তার মৃত্যুর পর ১৯৮৮ সালে সংবাদ পত্রিকার সাহিত্য পাতায়। তিনি ছাত্র অবস্থায় রসবল্লভ ছন্দনামে ‘ভল্টো হাওয়া’ নামক একটি প্রহসন রচনা করেছিলেন। সেটি রচনা ও অভিনয় করেছিলেন শান্তিনিকেতনে।

রথীন্দ্রকান্ত চৌধুরীর চাকরী জীবন শুরু হয় ১৯৪৫ সালে চিকন্দী হাই স্কুলে শিক্ষক হিসেবে। সেখানে তিনি চাকরি করেন ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত। এরপর তিনি যোগদান করেন কলকাতা থেকে প্রকাশিত স্বর্ণকমল ভট্টাচার্যের অগ্রণী পত্রিকায়। অগ্রণী পত্রিকার পর যোগদান করেন অরণী পত্রিকায়। ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত অবস্থান করেন কলকাতায়। ১৯৫০ সালে বালুচরে ফিরে এসে যোগ দেন পালং হাই স্কুলের অস্থায়ী শিক্ষক হিসেবে। পরবর্তীতে তিনি সেখানে স্থায়ীভাবে যোগ দেন। ১৯৫৪ সালে পালং হাই স্কুল ছেড়ে যোগ দেন তুলাসার গুরু দাশ উচ্চ বিদ্যালয়ে। সেখানে তিনি চাকরি করেন ১৯৬০ সাল পর্যন্ত।

রথীন্দ্রকান্ত ঘটক চৌধুরী ছিলে ঢাকা বেতার কেন্দ্রের লোকগীতি উৎসব’ অনুষ্ঠানের প্রস্তাবক। ১৯৫৬ সালে তিনি বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সিরাজুদ্দিন সরদার কে নিয়ে ঢাকা বেতার কেন্দ্রে যান। সেখানে তার বন্ধু ঢাকা বেতার কেন্দ্রের সহকারী পরিচালক শামসুল হুদা চৌধুরীকে গ্রামের আনাচে-কানাচের প্রতিভাবান শিল্পীদের নিয়ে লোকগীতি উৎসব চালুর প্রস্তাব দেন। তার প্রস্তাব ও উদ্যোগের উপর ভিত্তি করে ১৯৫৭ সালের ২১শে মার্চ রাত ৯টা থেকে ঢাকা বেতার কেন্দ্রে ১ম লোকগীতি অনুষ্ঠান শুরু হয়। শামসুলহক চৌধুরীর পরিকল্পনায় তিনি তরজা বিচারের ভূমিকা পালন করেন। সে অনুষ্ঠানের প্রধান প্রধান শিল্পিদের মধ্যে ছিলেন মুর্শিদী গায়ক আবদুল হালিম বয়াতি, হাজেরা বিবি, পুথি গায়ক শাকিম আলী বয়াতি সহ অনেক নামকরা কবি ও গায়ক। এ লোকগীতি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে গ্রামের আনাচে-কানাচের শিল্পীরা এক সময় বড় শিল্পী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। আর এরপর থেকেই গায়ক গায়িকাদের রেডিওতে গান গাওয়ার প্রচলন শুরু হয়।

শরীয়তপুর মহাকুমা প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৭৭ সালের ১লা নভেম্বর। রথীন্দ্রকান্ত ঘটক চৌধুরী মহকুমা স্থাপনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। মহকুমা হিসেবে সদরের স্থান নির্বাচনও ছিল তার অবদান। ১৯৭৮ সালে তার উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় শরীয়তপুর শিল্পকলা একাডেমী। তিনি প্রতিষ্ঠাকালে ছিলেন এর সম্পাদক এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ছিলেন সহসভাপতি। শরীয়তপুর কলেজ ও শরীয়তপুর বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ও সরকারি করনে তার অবদান ছিল। ১৯৮২ সালের ১৬ জুলাই রথীন্দ্রকান্তের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় শরীয়তপুর পাবলিক লাইব্রেরী। ১৯৮২ সালের ২৩শে জানুয়ারী পাবলিক লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠা কারার জন্য রথীন্দ্রকান্তঘটক চৌধুরীকে আহবায়ক করে একটি কমিটি গঠন করা হয়। প্রতিষ্ঠাকেলে তিনি ছিলেন এর সম্পাদক এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি এ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।

শরীয়তপুরকে মহকুমা থেকে জেলা প্রতিষ্ঠায় তিনি মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। ১৯৮৩ সালে শরীয়তপুর মহকুমা বাতিল করে উপজেল গঠন করলে জেলা বাস্তবায়ন কমিটি গঠনের উদ্যোগ নেয়া হয়। শরীয়তপুর পাবলিক লাইব্রেরীতে রথীন্দ্রনাথের সভাপতিত্বে সভা অনুষ্ঠিত হয় এবং রথীন্দ্রকান্ত ঘটক চৌধুরীকে সভাপতি করে ‘শরীয়তপুর জেলা বাস্তবায়ন কমিটি’ গঠন করা হয়। রথীন্দ্রনাথের নেতৃত্বে শরীয়তপুরের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সভা-সমাবেশ করেন। অবশেষে তাদের সফল প্রচেষ্টায় ১৯৮৪ সালের ১লা মার্চ বাংলাদেশ সরকার শরীয়তপুরকে জেলা হিসেবে উন্নীত করে।

১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর অনেকে দেশ ছেড়ে ভারত চলে যায়। ছাত্র সংকটের কারনে ১৯৫৬ সালে পালং ও তুলাসার স্কুল দুটিকে একত্রিত করা হয়। তিনি তখন ছিলেন তুলাসার গুরুদাশ হাই স্কুলের শিক্ষক। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীনের পর রথীন্দ্রনাথের উদ্যোগে পালং উচ্চ বিদ্যালয়কে আবার তার পূর্বের জায়গায় ফিরিয়ে নেয়া হয় এবং এটিকে একটি পূর্ণাঙ্গ বিদ্যালয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়।

অবশেষে ১৯৮৮ সালের ১৫ই জুন তিনি দুনিয়া থেকে চিরবিদায় নেন। মৃত্যুর সময় তার বয়স হয়েছিল ৬৭ বছর। মৃত্যুকালে তিনি রেখে গেছেন স্ত্রী কন্ঠশিল্পী রানীঘটক চৌধুরী ও নয় পুত্র ও কন্যা (শিখা, শীলা, অনীক, হাসি,খুশী, পূর্ণিমা, অভীক, অমিত ও মালা)। মৃত্যুর পর তার স্মৃতিস্বরূপ ১৯৮৮ সালের ১২ জুলাই প্রতিষ্ঠা করা হয় ‘রথীন্দ্র সাহিত্য পরিষদ’। এ পরিষদের সভাপতি ছিলেন সাহিত্যিক আবু ইসহাক।

রথীন্দ্র কান্ত ঘটক চৌধুরীর সংক্ষিপ্ত জীবণচক্র দেখলেই বুঝাযায় কতটা সমৃদ্ধ ছিলো তাঁর সমাজ সেবা ও সাহিত্য জীবন। রথীন্দ্রকান্ত ঘটক চৌধুরী শরীয়তপুর জেলার একটি গর্বের নাম। রথীন্দ্রকান্ত ঘটক চৌধুরী নিজেকে মগ্ন রেখেছিলেন সমাজ সেবায়, কবিতায়, প্রবন্ধে, সাহিত্যের নানান শাখায়, পত্রিকা সম্পাদনায়। প্রচার বিমুখ এই কবি তাঁর অসংখ্য কীর্তি রেখে গেছেন আমাদের মাঝে। তাঁর অধিকাংশ লেখাই অপ্রকাশিত অবস্থায় আছে। যৎ সামান্য যা প্রকাশিত হয়েছে তাতেই সে আলোড়িত করেছেন সাহিত্যপ্রেমীদের হৃদয়। তার প্রকাশনা আলোর ঝলকানির মত আবির্ভূত হয়েছে পাঠকের হৃদয়ে। আমাদের উচিত তাঁর কীর্তি সকলের সামনে তুলে ধরা। তাঁকে সকলের সামনে নিয়ে আসা। রথীন্দ্রকান্ত ঘটক চৌধুরীর সাহিত্যরস সমৃদ্ধ লেখা নতুন প্রজন্ম হাতে পেলে অনেক কিছু শিখতে পারবে, অনেক অজানা জানতে পারবে। আগামী ২০২১ সালে কবির জন্ম শত বার্ষিকী।

লেখকঃ আসাদুজ্জামান জুয়েল, আইনজীবি, লেখক ও কলামিস্ট।

 

আপনার মতামত দিন