ভূমিকা: প্রত্যন্ত অঞ্চল হিসেবে বাংলাদেশ অন্যান্য দেশের চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নয় । খৃ.পূ.৫০০ বছর পূর্বেও অনেক প্রত্নতাত্তিক , স্থাপত্য কর্মও পাওয়া যায় আমাদের এই বাংলাদেশে। নরসিংদী জেলার রায়পুরা থানায় অবস্থিত ওয়ারী বটেশ্বর গ্রামে খননের ফলে আড়াই হাজার বছরের পূরাতন গ্রামে ও বসত ঘরের মেঝে, অসম রাজার দেওল পুরাতন স্থাপত্যকলারই স্মৃতি বহন করে । বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায়ই কিছু সুলতানি ও মুগল আমলিয় প্রাচীন স্থাপত্যকলার সন্ধান পাওয়া যায় । সেদিক থেকে শরীয়তপুর জেলার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অনেক নিদর্শন । ৩ থেকে ৫ শত বছরের পুরাতন মসজিদ, মন্দির, মঠ, গেট, ব্রিজ, দোচালা বিশিষ্ট ভবন আজও প্রাচীন শিল্প শৈলীর স্বাক্ষর বহন করে । শরীয়তপুর জেলায় ১টি তিন গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদসহ ১ গম্বুজ বিশিষ্ট প্রাচীন সুলতানি ও মোগল আমলের মসজিদের সংখ্যা ১৮ টি । তার মধ্যে ৬ টি মসজিদ ইতিমধ্যে ভেঙ্গে ফেলা হলেও সেখানে ৬টি আধুনিক মসজিদ তৈরি হয়েছে। বর্তমান প্রবন্ধে প্রতিটি মসজিদের বিবরণ সংক্ষিপ্ত আকারে দেয়ার চেষ্টা করা হবে।
এই জেলার এক গম্বুজ বিশিষ্ট মুগল আমলিয় ১৮টি মসজিদের মধ্যে পালং থানায় ৫টি, নড়িয়া থানায় ৫টি, ভেদরগঞ্জ থানায় ৫টি যার একটি তিন গম্বুজ বিশিষ্ট, ডামুড্যা থানায় ২টি, গোসাইরহাট থানায় ১টি। জাজিরা থানায় কোন প্রাচীন মসজিদ নাই। প্রতিটি মসজিদের পাশেই রয়েছে একটি করে পুকুর। কোন কোন পুকুরে ইট দ্বারা শান বাধানো ঘাট।
নকসা ও অলংকরণঃ এই মসজিদ গুলোর আকৃতি প্রায় সবগুলো একই রকম। চৌকোনাকার দৈর্ঘ্য প্রস্থ সমান। ২/১টি মসজিদের দৈর্ঘ্য প্রস্থ সামান্য ব্যতিক্রম। সবগুলো একই মাপের এবং একই ডিজাইনে তৈরী। ইট, চুন, সুরকি ও পলেস্তারা উপাদানে আয়তাকার ভূমি পরিকল্পনায় নির্মিত। প্রতিটি মসজিদের ইট, চুন-সুরকি একইরূপ। ইটের পরিমাপ হল দৈর্ঘ্য এবং প্রস্থ ৬দ্ধ৫ ইঞ্চি। পুরু ১ ইঞ্চি। প্রতিটি মসজিদের খিলান প্রাক মুগল যুগের কৌনিক রীতিতে নির্মিত। করণ হোগলা শহীদুল ইসলাম চৌধুরীর বাড়ির পাশে তিন গম্বুজ বিশিষ্ট মহজিদটির তুলনা করা যায় কুষ্টিয়ার হরিনারায়নপুর মসজিদ, শেরপুরের খেরুয়া মসজিদ, কুষ্টিয়ার ঝাউদিয়া মসজিদ, ভেড়ামারার সাতবাড়ীয়ার মসজিদের সঙ্গে। এই জেলার শিবপুর তালুকদার বাড়ির মসজিদটির দুদিকের গোলাকার খুটিগুলো ভরাটকৃত ত্রিকোনাকার পান্দানতিফ পদ্ধতিতে নির্মিত। সরাসরি খিলান শীর্ষ হতে উত্থিত। এক গম্বুজ বিশিষ্ট এই ১৮টি মসজিদের মধ্যে এই পশ্চিম পার্শ্বে দুটি উচু গোলাকৃত দুটি খুটি দেখা যায়। অন্য কোনটিরই এইরূপ দেখা যায় না। তবে তেলিপাড়া বান্দা লাকুড়িয়া বাড়ির মসজিদ এবং চামটা আলফাজদ্দিন শিকদার বাড়ির মসজিদ দুটির নমুনা বা গঠন প্রণালী অন্যান্য মসজিদের মত হলেও এর ইটগুলোর দৈর্ঘ্য প্রস্থ ১০দ্ধ৫ ইঞ্চি এবং পুরু ৩ ইঞ্চি।
এ দুটি মসজিদ ব্যতীত অন্য ১৬টি মসজিদেও ইটা চৌকানাকার দৈর্ঘ্য প্রস্থ ৬x৫ ইঞ্চি, পুরু ১ ইঞ্চি। তবে এই মসজিদ দুটি যে মুগল যুগের শেষ দিকে অথবা বৃটিশ যুগের প্রথম দিকে নির্মিত তা ইটের আকৃতি দ্বারা বুঝা যায়। নামাজ গৃহের অভ্যন্তরে প্রবেশের জন্য কোনটির সামনে একটি দরজা এবং কোনটির ৩টি দরজা আবার কোনটির ১টি দরজা ২টি জনালা। প্রতিটি মসজিদের সামনের একটি দরজা বরাবর দুটি মেহরাব। মেহরাবগুলোর উভয় পার্শ্বে যুগল খিলান নির্মিত হয়েছে। কোন মসজিদেরই মিম্বার ছিল না। বর্তমানে যাহারা মসজিদের ইমাম তারা প্রত্যেকেই বলেন যে, খুতবা পড়ার জন্য মিম্বারগুলো আমরা তৈরি করেছি। এতে প্রমাণিত হয় যে, মসজিদগুলোতে তখন জুমার নামাজ পড়া হত না। মেহরাবগুলো কোন কোনটার কিবলা দেওয়ালের বাইরের দিকে বর্ধিত। আবার কোন কোনটার মসজিদের ভিতরাংশে ত্রিকোণাকার। ২ থেকে ৩ ফুট গভীরতা মেহরাবগুলো অবতলাকাওে শুরু হলেও নিম্নাংশ আয়তাকার। কোন কোন মসজিদের ভিতরাংশে চতুর্দিকের উপরাংশ রেখা দ্বারা আবৃত এবং চারপাশে ফুল, লতা-পাতার নকশা খচিত। নান্দনিক দিক থেকে সুউচ্চ এই মসজিদগুলো বেশ আকর্ষণীয়। গম্বুজগুলির শীর্ষভাগে মার্লন নকশাযুক্ত প্যারাপেটকে গুরুত্বপূর্ণ অলংকরণ হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। প্রতিটি মার্লনের গায়ে ঐসব অংকিত নকশা মুসলিম স্থাপত্যের একটি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ বিষয়। মুগল আমলিয় তৈরি এ সকল মসজিদের অলংকরণ মুসলিম স্থাপত্য শিল্পের এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে আজও সমাদৃত।
মসজিদগুলি মুগল আমলের শেষ দিকে একটু ধণাঢ্য পরিবারের ব্যক্তিবর্গ যে নির্মাণ করেছেন তাতে সন্দেহ নেই।
নিম্নে মসজিদগুলোর অবস্থান ও নামকরণসহ সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেওয়া হলো;
উত্তর বিলাসখান মসজিদঃ শরীয়তপুর শহর থেকে ২ কি.মি. উত্তর পূর্বে কোনে পালং থানা হতে নড়িয়া থানার আদি রাস্তার পূর্ব পাশে এই মসজিদটি অবস্থিত। উত্তর দক্ষিণ ও পূর্ব পাশে ১টি করে সর্বমোট ৩টি দরজা, যার উচ্চতা ৪ ফুট। দৈর্ঘ্য প্রস্থ সমান ‘১৫x১৫ ফুট’। ভিতরে ইমামসহ ১১ জন লোক নামাজ আদায় করার মত স্থান ছিল। মসজিদটির মেহরাব ধ্বংসপ্রাপ্ত। তবে এই মসজিদের গম্বুজটির একটি বিশেষত্ব এই যে, চতুর্দিকের চুন সুরকির পলাস্তার প্রায় সমান সমান এবং মধ্যস্থলে ৩ ফুট লম্বা কারুকার্য খচিত একটি লৌহ দন্ড ছিল যা দেখতে তাজমহলের উপরে অবস্থিত দন্ডের ন্যায়। কয়েক বছর পূর্বে মসজিদটি ভেঙ্গে তদস্থলে টিনের মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে।
বালাংগী মসজিদ : উত্তর বিলাসখান মসজিদটির ডাশ ৪ কি.মি. দক্ষিণে এই মসজিদটি অবস্থিত। এই মসজিদটি একটু ছোট। যার পরিমাপ দৈঘ্য প্রস্থ ১০/ ১০ ফুট। ভিতরে ইমামসহ ৬ জন্ লোক নামাজ করতে পারতেন। পূর্বে ও দক্ষিণ পার্শ্বে দুটি দরজা বিশিষ্ট এই মসজিদটি অন্যান্য মসজিদের তুলনায় কম পুরাতন বলে মনে হয়। এই মসজিদটিও কয়েকবছর পূর্বে ভেঙ্গে সেখানে এক পাঁকা মসজিদ তৈরী করা হয়েছে।
দক্ষিণ বালুচরা মসজিদ ঃ বালাংগীর মসজিদের ঠিক ২ কি.মি. দক্ষিণে কবি রথীন্দ্র কান্ত ঘটক চৌধুরী বাড়ির দক্ষিণ পার্শ্বে গ্রামের দক্ষিণ প্রান্তে এই মসজিদটির অবস্থান। দৈর্ঘ্য প্রস্থ ৮/৮ ফুট। পূর্ব পার্শে¦ ও দক্ষিণ পার্শ্বে দুটি দরজা। দরজার উচ্চতা ৪ ফুট। দেয়াল ২০ ইঞ্চি পুরু। ইমামসহ ৫ জন লোক নামাজ আদায় করতে পারতেন। শরীয়তপুর জেলায় ১ গম্বুজ বিশিষ্ট অন্যান্য মসজিদগুলির চেয়ে সবচেয়ে ছোট আকৃতি বিশিষ্ট এই এলাকায় মুসলমানের সংখ্যা কম ছিল বলে এত ছোট আকারে মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছে ।
কির্তীনগর মসজিদ ঃ শরীয়তপুর শহর হতে প্রায় ১০ কি.মি. পশ্চিমে অবস্থিত। মুগল আমলের অনেক কীর্তি ছিল বলেই এই এলাকার নাম হয়েছে কির্তীনগর। যার নিদর্শন এক গম্বুজ বিশিষ্ট এই মসজিদ। এই স্থানের পরিবার দবির মোল্লার বাড়ির পাশেই মসজিদটি অবস্থিত ছিল। কিছুদিন পূর্বে এটি ভেঙ্গে এখানে তৈরি করা হয় নতুন মসজিদ। বালাংগীর মসজিদের ন্যায় এই মসজিদ। যার দৈর্ঘ্য প্রস্থ ১০দ্ধ১০ ফুট ২ দরজা বিশিষ্ট মসজিদের নমুনা খুবই সুন্দর। ইমামসহ ৬ জন লোক ভিতরে নামাজ আদায় করতে পারতেন।
কাঠ হুগলী মসজিদ ঃ কাঠ হুগলী মসজিদটি ভেদরগঞ্জ থানায় অবস্থিত। যার দক্ষিণ পার্শ্বে বৃহৎ আকৃতির একটি দিঘী ছিল। এখনও ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। মসজিদটির দৈর্ঘ্য প্রস্থ ২৪দ্ধ২৪ ফুট। মসজিদটির দেয়াল ৫ ফুট পুরু। উত্তর দক্ষিণে দুটি দরজা এবং পূর্ব পার্শ্বে ৩টি দরজা। ভিতরাংশে ইমামসহ ২৫ জন লোক নামাজ আদায় করতে পারেন। সামনের হেরাব ৪ ফুট উচু। যাহা পশ্চিম দেয়ালে প্রবেশকৃত। মসজিদ সংলগ্ন দক্ষিণ পার্শ্বে দিঘীর সাথে বড় ঘাটলা ছিল, যা এখন বিলুপ্ত। বর্তমানে মসজিদটির উপরে পলাস্তার করে চুনকাম করা হয়েছে।
করন হোগলা মসজিদ ঃ করন হোগলা মৌজায় একই আকৃতি বিশিষ্ট ৩টি মসজিদ দেখতে পাওয়া যায়। বর্তমানে দুটিতে নামাজ আদায় করা হয় এবং একটি পরিত্যক্ত। প্রাক্তন পাকিস্তান আমলের মন্ত্রী গিয়াস উদ্দিন চৌধুরীর বংশধর ফারুক চৌধুরীর বাড়ির সামনে অবস্থিত মসজিদটির বাইরে চতুর্দিকে দেয়ালের অংশ এখনও বিদ্যমান। মসজিদটির দৈর্ঘ্য প্রস্থ ১১x১১ ফুট। ইমামসহ ৭ জন লোক নামাজ আদায় করেন। সামনে দুটি দরজা যাহার উচ্চতা ৪ ফুট। মসজিদের দেয়াল ২০ ইঞ্চি পুুরু।
মসজিদের সামনে রয়েছে ঘাট বাধানো বড় একটি পুকুর। এই মসজিদটির বিশেষত্ব হলো মসজিদটির ৪ গজ দক্ষিণ পার্শ্বে অবস্থিত একটি হুজরাখান্ াযার উচ্চতা ৬ ফুট। দৈর্ঘ্য ৮ ফুট প্রস্থ ৬ ফুট। কোন মসজিদের পার্শ্বে এইরূপ হুজরাখানা দেখতে পাওয়া যায় নাই। হুজরাখানাটিও মসজিদের অনুরূপ এবং মসজিদের ইট দ্বারা গাঁথুনীযুক্ত।
করণ হোগলা চার আনী মসজিদ ঃ শহীদুল ইসলাম চৌধুরীর বাড়ির দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত এই মসজিদটি চার আনী মসজিদ বলে পরিচিত। জানা যায় স্থানীয় জমিদার মুন্সী মনিরুদ্দিন চৌধুরী এটি নির্মাণ করেছে। এই মসজিদটির বিশেষত্ব হলো এটি ৩ গম্বুজ বিশিষ্ট। দৈর্ঘ্য প্রস্থ ৩৩x১৫ ফুট। সামনে ৩টি দরজা এবং উত্তর দক্ষিণে দুটি দরজা। প্রত্যেকটি গম্বুজের মধ্যবর্তী স্থানে একটি করে মোট ৩টি মেহরাব। অন্য দুটির চেয়ে মধ্যবর্তীটা একটু বড় এবং দুই পাশে ৪টি জানালা আছে। মসজিদটির বাহির দিকে গোলাকার বিশিষ্ট চতুর কোনে ৪টি টাওয়ার। ইমামসহ ৫০ জন লোক নামাজ আদায় করতে পারেন। মসজিদটির পূর্ব পার্শ্বে বড় একটি পুকুর রয়েছে। তবে এই মসজিদটির আরও বৈশিষ্ট হলো সমতল ভূমি হতে ৩ ফুট উচ্চ স্থানে মসজিদটির অবস্থান। পূর্বদিক দিয়ে সমতল ভূমি হতে উঠার সিঁড়ি রয়েছে।
পার্শ্ববর্তী মসজিদ ঃ ৩ গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদটির মাত্র ৬০ গজ দক্ষিণে রয়েছে আরও একটি এক গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ। যা বর্তমানে পরিত্যক্ত। দের্ঘ্য প্রস্থ ১৫দ্ধ১৫ ফুট। সামনে ৩টি দরজা আছে। মসজিদটির ভিতরে প্রবেশ করা ভয়ের কারণ। মসজিদটির চতুর্দিক গাছ-গাছড়াও জঙ্গলে পরিপূর্ণ থাকার কারণে অভ্যন্তরে পরিদর্শন করা যায় নাই।
কাজী বাড়ির মসজিদ ঃ ডামুড্যা বন্দর থেকে ১/২ কি.মি. উত্তর পশ্চিম কোনে অবস্থিত কাজী বাড়ির মসজিদ। মসজিদটির দৈর্ঘ্য প্রস্থ ১০দ্ধ১০ ফুট। সামনে মাত্র ১টি দরজা। যার উচ্চতা ৫ ফুট এবং প্রস্থ ৩০ ইঞ্চি।
দুই পার্শ্বে ২টি জানালা আছে। মসজিদে ইমামসহ ৬ জন লোক নামাজ আদায় করতে পারেন। এই মসজিদটির সামনে একটি কবর আছে। প্রায় ৩০০ বছর পূর্বে আফু কাজী ও গাদু কাজী নামে যমজ দুই ভ্রাতা এই মসজিদটি তৈরি করেছে বলে কাজী বংশের শেষ বংশধর আনিছউদ্দিন কাজীর নিকট রক্ষিত পুস্তক অনুসারে জানা যায়। মসজিদের সামনের কবরটি উক্ত দুই ভাইয়ের যে কোন একজনের কবর। কবরের উপরে দো’চালা বিশিষ্ট ইটের ছাউনি আছে। তবে স্বাভাবিক কবরের চেয়ে এই কবরটি বেশ বড়।
উত্তর ডামুড্যা মীরা বাড়ির মসজিদ ঃ এই মসজিদটিও কাজী বাড়ির মসজিদের অনুরূপ। কিছুদিন পূর্বে মসজিদটি ভেঙ্গে সেখানে আধুনিক কায়দায় একই আকৃতির মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে। বর্তমানে মসজিদ সংলগ্ন হাফেজিয়া মাদ্রাসা গড়ে উঠেছে, যার নাম উত্তর ডামুড্যা হাফেজিয়া মাদ্রাসা।
শিবপুর মসজিদ ঃ গোসাইরহাট থানায় নাগের পারা বাজার থেকে প্রায় ৪ কি.মি. পশ্চিমে শিবপুর গ্রামের সিরাজ তালুকদারের বাড়ির দক্ষিণ পাশে অবস্থিত এই মসজিদটি। এই মসজিদটি এখনও দেখতে চকচকে সুন্দর দেখায়। মসজিদটির দৈর্ঘ্য প্রস্থ ২১দ্ধ২১ ফুট। সামনে ৩টি এবং উত্তর দক্ষিণ দুই পার্শ্বে ২টি মোট ৫টি দরজা, যার উচ্চতা ৫ ফুট। দরজাগুলো ৩৬ ইঞ্চি প্রস্থ। প্রতি লাইনে ১০ জন করে ইমামসহ ৩১ জন লোক নামাজ পড়তে পারেন। মসজিদটির পশ্চিম দেওয়ালের সাথে ২টি গোলাকৃত গম্বুজ আছে। যার উচ্চতা প্রায় ২৫ ফুট। মসজিদটির ভিতরাংশে নকসা করা কারুকার্য খচিত। মসজিদটির বাইরে তিন দিকে ৩ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট দেওয়াল, যার উপরে উঠে বসা যায়। দেওয়াল উত্তর দক্ষিণ এবং পূর্ব পশ্চিম ২১দ্ধ৩১ ফুট। মসজিদের সামনের প্রাঙ্গনও চুন-সুরকি তৈরি পাঁকা। মসজিদটির পশ্চিম পাশে একটি বৃহৎ আকৃতির পুকুর আছে এবং পুকুরের উত্তর পূর্বে ১৫টি সিড়ি বিশিষ্ট একটি ঘাটলা আছে। মসজিদের মুসল্লিরা যাতে পুকুরে ওজু করে মসজিদে প্রবেশ করতে পারে তার জন্য বোধহয় এই ঘাটলাটি তৈরী করা হয়েছে। যা মসজিদটির ইটের আদলেই তৈরি।
কুলকাঠি কাদির ছৈয়াল বাড়ির মসজিদ ঃ কুলকাঠি কাদির ছৈয়াল বাড়ির মসজিদ নড়িয়া থানা হতে ৩ কি.মি. পূর্বে মূলফৎগঞ্জ আলিয়া মাদ্রাসার দক্ষিণে এই মসজিদটি অবস্থিত। এই মসজিদটিও দৈর্ঘ্য প্রস্থ ১০দ্ধ১০ ফুট ছিল। মসজিদটি বর্তমানে ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে এবং সেখানে গড়ে উঠেছে এক নতুন মসজিদ। তবে এক গম্বুজ বিশিষ্ট পুরাতন মসজিদের ভিতরে যে খোদাই করা নামাংকিত পাথরটি ছিল তা বর্তমান মসজিদের গাত্রে সেটে দেয়া হয়েছ্ েতাহাতে ১৪৪১ খ্রিস্টাব্দে ঐ মসজিদটি নির্মাণকাল লিপিবদ্ধ আছে। সে হিসেবে এই মসজিদটি সুলতানি আমলের বলিয়াই মনে হয়।
চামটা করাতী বাড়ি মসজিদ ঃ মূলফৎগঞ্জ থেকে প্রায় ১৫ কি.মি. দক্ষিণে এই মসজিদটি অবস্থিত। মসজিদটির দৈর্ঘ্য প্রস্থ ১০দ্ধ১০ ফুট। উত্তর দক্ষিণে ও সামনে করে মোট ৩টি দরজা। যার উচ্চতা ৫ ফুট প্রস্থ ৩০ ইঞ্চি। দেওয়াল ২৫ ইঞ্চি পুরু। ডামুড্যা কাজী বাড়ির মসজিদের ন্যয় এই মসজিদটি। ইমামসহ ৬ জন লোক নামাজ অদায় করতে পারেন। মসজিদের পিছনের দুপাশে দুটি গোলাকৃত ৩ ফুট খুটির সাথে সংযুক্ত খিলান দ্বারা সংযুক্ত উপরাংশ কৌনিক আকরে উত্থিত।
শিকদার বাড়ির মসজিদ ঃ করাতী বাড়ির মসজিদ হতে ১ কি.মি. পূর্বে এই মসজিদটি অবস্থিত। ইহার দৈর্ঘ্য প্রস্থ ১৬দ্ধ১৬ ফুট। দু’পাশে ২টি সামনে ১টি মোট ৩টি দরজা, যার উচ্চতা ৫ ফুট প্রস্থ ৩০ ইঞ্চি। মেহরাম মসজিদের ভিতরে দেওয়ালের সহিত সংযুক্ত। যার উচ্চতা ৩ ফুট প্রস্থ দেড় ফুট। তবে এই মসজিদটির সবচেয়ে বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মসজিদের চারকোনে চারটি গোলাকৃত মূল গম্বুজের মত। উচু প্রায় ২০ ফুট। মসজিদের সহিত খিলান সংযুক্ত খুটি।
প্রতিটি খুটির উপরিভাগে সংযুক্ত প্রায় ৩ ফুট নকসাকৃত লৌহ দন্ড। একটি ইতিমধ্যে ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে মাইক লটকানোর জন্য। ইমামসহ ১৫ জন লোক নামাজ আদায় করতে পারেন। কিন্তু এই মসজিদটি অন্যান্য মসজিদের সামঞ্জস্যপূর্ণ হলেও এর ইটগুলি বেশ বড়। ইটগুলোর দৈর্ঘ্য ১০ ইঞ্চি প্রস্থ ৫ ইঞ্চি এবং ৩ ইঞ্চি পুরু।
বান্দা লাকুরিয়া বাড়ির মসজিদ ঃ শিকদার বাড়ির মসজিদ হতে ১ কি.মি. পূর্বে এই মসজিদটি অবস্থিত। মসজিদটির দৈর্ঘ্য ১৮ ফুট প্রস্থ ১৮ ফুট। মসজিদটির দক্ষিণ ও পূর্বে ১টি করে দুটি দরজা যার উচ্চতা ৫ ফুট প্রস্থ ৩০ ইঞ্চি। মসজিদের বাইরের চারকোনে ৪টি গোলাকৃত খুটি দ্বারা সংযুক্ত। খুটির উপরিভাগ নকশা দ্বারা অলংকৃত। মসজিদের ভিতরাংশে চতুর্পার্শ্বে গোল লতা-পাতা নকশা দ্বারা খচিত। ইমামসহ ২৫ জন লোক এই মসজিদে নামাজ আদায় করতে পারেন। এই মসজিদের উত্তর ও দক্ষিণ পার্শ্বে দরজার উপরিভাগে লতা-পাতা অংকিত নকশা আজও নতুন বলে মনে হয়।
ধামসী মসজিদ ঃ পালং থানা সদর থেকে ৫ কি.মি. দক্ষিণ পূর্ব কোন পাচু শেখের বাড়ির পাশে এই মসজিদটি অবস্থিত। যার দৈর্ঘ্য প্রস্থ ১০দ্ধ১০ ফুট। ১টি দরজা ও উত্তর দক্ষিণে দুটি জানালা ছিল। ইমামসহ ৬ জন লোক নামাজ আদায় করতে পারেন। দরজা জানালা বালাংগীর মসজিদের ন্যায়। অনেকে এই মসজিদটিকে নৌ-ফকিরের দরগা বলত। কয়েক বছর পূর্বে মসজিদটি ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। সেখানে গড়ে উটেছে নতুন মসজিদ।
নাজিমপুর মসজিদ বাড়ির মসজিদ ঃ প্রকৃতপক্ষে মসজিদটি ছিল হোসেন আলী বেপারীর বাড়ির পাশে। তবে ইহা মসজিদ বাড়ি নামেই পরিচিত। এই মসজিদটি আকৃতির দিক থেকে একটু বড়। যাহার দৈর্ঘ্য ২৪দ্ধ২৪ ফুট। ইমামসহ ২৫ জন লোক নামাজ আদায় করতে পারতেন।
সামনে একটি দরজা এবং দুপাশে দুটি জানালা ছিল। এই মসজিদের দরজাটি ৫ ফুট উচু, ৩০ ইঞ্চি প্রশস্ত। কিছুদিন পূর্বে এই মসজিদ ভেঙ্গে সেখানে নির্মাণ করা হয়েছে একটি নতুন মসজিদ। এই মসজিদটিও ভেদরগঞ্জ থানায় অবস্থিত।
শরীয়তপুর জেলায় অবস্থিত এই ১৮টি এক গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ বাংলাদেশে মুগল স্থাপত্যে সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ।
তথ্য সূত্রÑ
১. সার্ভে রিপোর্ট অফ বৃহৎ ফরিদপুর।
২. প্রভাতী শতবর্ষ (১৮৯৮-১৮৯৯) শরীয়তপুর।
৩. ফরিদপুরের ইতিহাস, আনন্দ নাথ রায়।
৪. আদর্শ ভূগোল, শ্রী মতিলাল চক্রবর্তী।
৫. শরীয়তপুর জেলার অতীত ও বর্তমান, আঃ রব শিকদার।
৬. চিকন্দি বার্তা/১৯০০।
৭. রুদ্রকর বার্তা/১৯৮০।
৮. দৈনিক সংবাদ।
৯. দৈনিক জনকণ্ঠ।
১০. মাওলানা সোনউল্লাহ খান/(৯০)।
১১. ফরমান আলী খাঁ/(১০০)।
১২. শ্রীমতি হেমাঙ্গিনী দেবী।
তথ্যসুত্রঃ ইতিহাস সমিতি পত্রিকা সংখ্যা ২৯-৩০ প্রকাশ কাল ২০০৫-২০০৭ সাল।
লেখকঃ আলী আহাম্মদ খান (এ্যাডভোকেট ও গবেষক)
টীকাঃ উল্লেখিত প্রবন্ধটি ইতিহাস সমিতি পত্রিকা, সংখ্যা ২৯-৩০ প্রকাশ কাল ২০০৫-২০০৭ সাল বই থেকে হুবহু তুলে ধরা হলো। উল্লেখিত মসজিদ গুলো প্রতক্ষ দর্শন করা হয়নি এবং ছবি সংযোজন করা সম্ভব হয়নি। প্রবন্ধটিকে আরো তথ্য সমৃদ্ধ করার জন্য তথ্য ও ছবি দিয়ে আমাদেরকে সহায়তা করতে পারেন। লেখকের পুরো পরিচয় জানা সম্ভব হয়নি। এ প্রবন্ধ সম্পর্কে নতুন তথ্য পেলে আমরা হালনাগাদ করবো। |
আপনার মতামত দিন