(চিত্রশিল্পী, ভাস্কর, ছাপচিত্রকর, চারুকলার শিক্ষক)
শরীয়তপুর জেলার ভেদরগঞ্জ উপজেলার দিগরমহিষখালী জন্মগ্রহনকারী আব্দুর রাজ্জাক একাধারে চিত্রশিল্পী, ভাস্কর, ছাপচিত্রকর ও চারুকলার শিক্ষক। বিদেশ থেকে চারুকলায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনকারী বাংলাদেশিদের মধ্যে আবদুর রাজ্জাক প্রথম ব্যক্তি। ১৯৫৭ সালে তিনি মাস্টার অব ফাইন আর্টস (এমএফএ) কোর্স সম্পন্ন করেন।
১৯৮৯ সালে শিল্পকর্মের সামগ্রিক স্বীকৃতি স্বরূপ জাতীয় পর্যায়ের শ্রেষ্ঠতম পুরস্কার একুশে পদকে ভূষিত হয়েছেন তিনি । একই বছর বাংলাদেশ চারুশিল্পী সংসদ সম্মান লাভ করেন।
“আমি প্রকৃতির খুব কাছে থাকার চেষ্টা করেছি। প্রকৃতি সদা পরিবর্তনশীল ও অসীম শক্তিশালী। প্রকৃতির নিয়মকে জানার চেষ্টা করেছি। জীবনকে পরিপূর্ণভাবে জানার ও রূপ দেয়ার ব্যাপারে আমি সবসময়ই আগ্রহী। রঙ, রূপ, রেখা, গড়ন ও স্পেসকে কেন্দ্র করে বিষয়বস্তুকে উপস্থাপন করতে চেষ্টা করি। তাই নানান পরিবর্তনের সঙ্গে আমার কাজও বিবর্তিত হয়।” নিজের শিল্পী জীবনকে এভাবেই তুলে ধরেছেন বাংলাদেশের প্রতিথযশা চিত্রশিল্পী আবদুর রাজ্জাক।
প্রকৃতিপ্রেমী আব্দুর রাজ্জাক প্রকৃতি ও জীবনকে নিখুঁতভাবে তুলে ধরেছেন তাঁর প্রতিটি শিল্পকর্মে। বহুমাত্রিক এই ব্যক্তিত্ব চিত্রশিল্পী, ছাপচিত্রী, ভাস্কর ও শিক্ষক প্রতিটি ক্ষেত্রেই দক্ষতা, সৃজনশীলতা ও মেধার স্বাক্ষর রেখেছেন। শিল্পকলা বিষয়ে লেখালেখিতেও তিনি সমান দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। বাংলাদেশের ভাস্কর্য শিল্পের বিকাশধারা তাঁর হাত ধরেই সমৃদ্ধ হয়েছে। আর্ট ইনস্টিটিউটের দ্বিতীয় ব্যাচের ছাত্র হিসেবে পরবর্তীতে তিনি বাংলাদেশের শিল্পকলার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ও নেতৃস্থানীয় ভূমিকা রেখেছেন।
আবদুর রাজ্জাক ১৯৩২ সালে বৃহত্তর তৎকালীন ফরিদপুর জেলার (বর্তমানে শরীয়তপুর জেলা) ভেদরগঞ্জ থানার দিগর মহিশখালি নামের এক প্রত্যন্ত গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা সাদর আলী আমিন ঢাকার তৎকালীন আহসানউল্লাহ সার্ভে ও ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুলের ছাত্র ছিলেন। কিন্তু কখনোই তিনি কোনো চাকরিতে যোগ দেননি বরং জীবিকার জন্য পারিবারিক জমিজমার ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। তাঁর মায়ের নাম রিজিয়া বেগম। চার ভাই, দু’বোনের মধ্যে আব্দুর রাজ্জাক সবার ছোট। ভাইরা সবাই ছিলেন শিক্ষিত। বড় ভাই এবং সেজো ভাই ছিলেন শহরে চাকুরিজীবী, মেজো ভাই গ্রামের স্কুলের প্রধান শিক্ষক এবং এলাকার খ্যাতিমান ফুটবলার। দু’বোনের সংসার জীবন গ্রামেই সীমাবদ্ধ ছিল।
প্রকৃতির সঙ্গে বেড়ে উঠেছে তাঁর শৈশব। বাবার কারণে রাজ্জাক বাড়িতে পেয়েছেন সার্ভেয়িং ও ড্রয়িং ইন্সট্রুমেন্ট এবং প্রচুর মৌজা-ম্যাপের সংগ্রহ। বাবা এসব মাঝে মাঝে ব্যবহার করতেন গ্রামের মানুষের জমি সংক্রান্ত মাপজোখের প্রয়োজনে। আর এ সব কিছুই তাঁকে ছবি আঁকার প্রতি মনোযোগী করে তুলেছিল।
গ্রামের প্রাথমিক ও নিম্নমাধ্যমিক স্কুলেই আব্দুর রাজ্জাক পড়াশোনা শুরু করেন। এরপর তিনি ফরিদপুর হাই স্কুলে এসে ভর্তি হন । ১৯৪৭ সালে যখন ভারত-বিভাগ হয় তখন ফরিদপুর হাই স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাশ করেন। ১৯৪৯ সালে ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজ থেকে দ্বিতীয় বিভাগে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেন। স্কুল জীবন থেকেই চমৎকার দক্ষতায় জলরঙ্গের নিসর্গ-দৃশ্যাদি আঁকতেন। কলেজে পড়ার সময় রসায়ন আর পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপকদের ছবি এঁকে খাতা ভরে তুলতেন। অভিভাবকদের আশা ছিল বিজ্ঞানের ভাল ছাত্র হিসেবে আবদুর রাজ্জাক কলেজ পেরনোর পর ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ভর্তি হবেন। এজন্য ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পর তাঁকে ঢাকায় তাঁর বড় ভাইয়ের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু সেদিকে তিনি মোটেই উৎসাহিত হলেন না। তাঁর আগ্রহ চারুকলার দিকে। আবদুর রাজ্জাকের মনোভাব দেখে বড় ভাই তাঁকে নিয়ে যান তৎকালীন আর্ট ইন্সস্টিটিউটের অধ্যক্ষ শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের কাছে। তাঁর ছবি আঁকার নমুনা দেখে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনও মুগ্ধ হয়েছিলেন। তখন আর্ট কলেজে ভর্তির জন্য মেট্রিক পাশ হলেই চলত। শিল্পাচার্যের সানুগ্রহে তিনি ভর্তি হন আর্ট ইনস্টিটিটে। তিনি ছিলেন ইনস্টিটিউটের দ্বিতীয় ব্যাচের ছাত্র। সেই ব্যাচে তিনি সতীর্থ হিসেবে পেয়েছিলেন ফরিদপুরের পূর্বপরিচিত শিল্পী আবদুর রশীদ এবং অন্যান্যদের মধ্যে কাইয়ুম চৌধুরী, মুর্তজা বশীর, জুনাবুল ইসলাম, একরামুল হক, ইমদাদ হোসেন প্রমুখ। প্রথম বছর থেকেই আবদুর রাজ্জাক ক্লাসে প্রথম হয়েছেন। ১৯৫৪ সালে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে স্নাতক ডিগ্রি সম্পন্ন করেন।
আবদুর রাজ্জাক যখন ঢাকায় আসেন তখন থেকেই পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শোষণ-বৈষম্যের বিরুদ্ধে বাঙালি জেগে উঠতে শুরু করেছে। ছাত্ররাই এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়। অন্যান্য বন্ধুদের সাথে আবদুর রাজ্জাকও যুক্ত হয়েছেন সেসময়ের বিভিন্ন আন্দোলনে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের সময় আর্ট কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রদের সবাই তরুণ। কেউ কেউ সরাসরি বাম আন্দোলনের সাথে যুক্ত। রাজ্জাক তখন বড় ভাই আব্দুল কাদিরের কাপ্তান বাজারের ছোট বাসাতেই থাকেন। আব্দুল কাদির সরকারি চাকুরে। সেখানে বসেই রাজ্জাক, রশীদ চৌধুরী সহ অন্য আন্দোলনকারীরা রাত জেগে বাংলা ভাষার দাবিতে পোস্টার আঁকতেন। সেসব পোস্টার শহরের বিভিন্ন দেয়ালে লাগাবার ব্যবস্থা করতেন। অনেক সময় নিজেরাই সে কাজ করতেন। প্রায় এসময় থেকেই তিনি কবি হাসান হাফিজুর রহমান, কবি আলাউদ্দিন আল আজাদ, আব্দুল গনি হাজারি, রণেশ দাশগুপ্ত প্রমুখ কবি-সাহিত্যিকদের সাথে ঘনিষ্ঠ হবার সুযোগ পান। শিল্পী আবদুর রাজ্জাক ছিলেন পল্লীকবি জসীম উদ্দিনের স্নেহধন্য।
স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করার পর কিছুদিন তিনি ঢাকার সরকারি গবেষণা সংস্থা ম্যালেরিয়া ইনস্টিটিউটে আর্টিস্ট ও মিউজিয়াম কিউরেটর হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এরপর প্রতিযোগিতামূলক ফুলব্রাইট বৃত্তি নিয়ে ১৯৫৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আইওয়া স্টেট ইউনিভার্সিটিতে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে পড়তে যান এবং ১৯৫৭ সালে মাস্টার অব ফাইন আর্টস ডিগ্রি (এমএফএ) লাভ করেন। এজন্য আবদুর রাজ্জাককে কোর্স ও ষ্টুডিও’র কাজের পাশাপাশি একটি থিসিসও লিখতে হয়েছে।
আমেরিকা থেকে পড়াশোনা শেষ করে আবদুর রাজ্জাক ১৯৫৮ সালে ঢাকার সরকারি আর্ট ইনস্টিটিউটে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ছাত্রদের আন্দোলনের মুখে ‘গভর্ণমেন্ট ইনস্টিটিউট অব আর্টস’ ইস্ট পাকিস্তান কলেজ অব আর্টস এন্ড ক্রাফটসে রূপান্তরিত হয় এবং তখন থেকে বিএফএ স্নাতক ডিগ্রির পাঠক্রম শুরু হয়। ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ জয়নুল আবেদিন ১৯৬৩ সালে রাজ্জাককে ভাস্কর্য বিভাগের দায়িত্ব দেন। প্রিন্ট-মেকিং, পেইন্টিং ও ড্রয়িংয়ে তিনি পারদর্শী ছিলেন। কিন্তু নতুন এ দায়িত্ব পেয়ে অবাক হলেও তিনি একে চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করেন এবং ভাস্কর্য বিভাগ গড়ে তোলেন। কাজটি খুব সহজ ছিল না। কিন্তু তিনি সাফল্যের অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। তাঁর হাতেই গড়ে উঠেছে এদেশের আধুনিক ভাস্কর্য চর্চার একগুচ্ছ প্রতিভাবান তরুণ শিল্পী- আনোয়ার জাহান, সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ, শামীম শিকদার, হামিদুজ্জামান খান, এনামুল হক এনাম প্রমুখ। স্বাধীনতার পর থেকে এই মাধ্যমটির বিকাশ ঘটে এবং এটি সাধারণ মানুষের কাছাকাছি আসে।
বিদেশ থেকে ফেরার পর রাজ্জাক কিছুদিন তাঁর সতীর্থ বন্ধু শিল্পী রশীদ চৌধুরীর সাথে মিলিতভাবে সেগুনবাগিচায় ড. কাজী মোতাহার হোসেনের বাড়ির বর্ধিত একাংশের দোতলায় একটি ছোট্ট ঘরে নিজেদের ছবি আঁকার স্টুডিও দাঁড় করান। যদিও এর স্থায়িত্ব কাল খুব বেশিদিন ছিল না। পরে কলাবাগানের একটি ছোট্ট বাসায় কাজ করেন কিছুদিন।
১৯৮৩ সালে তিনি কলেজ অব আর্টস এন্ড ক্রাফটসের অধ্যক্ষের দায়িত্ব নেন। তাঁর সময়েই এটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভূক্ত হয় এবং একটি ইনস্টিটিউটে রূপান্তরিত হয়। ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত তিনি ইনস্টিটিউটের ভারপ্রাপ্ত পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৩ সালে ৬০ বছর বয়সে বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন নিয়মে অবসর নিয়ে দু’বছরের জন্য পুনঃনিয়োগ গ্রহণ করেন। এরপর দুই বছর এবং পরে আরো এক বছর তিনি অধ্যাপনা করেন। আশির দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য অনুষদে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে ড্রয়িং ও ডিজাইন শেখাতেন।
ছাত্রাবস্থা থেকেই জলরং ও তেলরং ছিল তাঁর প্রিয় মাধ্যম। তবে আমেরিকায় পড়তে গিয়ে তিনি স্পেশালাইজেশন করেন প্রিন্ট মিডিয়ামে, অর্থাৎ গ্রাফিস্ক বা ছাপচিত্রে। আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তিনি প্রিন্ট-মাধ্যমে শিক্ষক হিসেবে পান বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রিণ্ট-মেকার প্রফেসার মরিসিও লাসানস্কিকে। লাসানস্কি নিবিষ্টপ্রাণ ছাত্র রাজ্জাককে অত্যন্ত যত্ন করে কাজ শিখিয়েছেন। প্রিন্ট-মেকিংয়ে রাজ্জাকের দক্ষতা ছিল অসামান্য এবং সেখানের ছাত্র থাকা অবস্থাতেই তিনি উত্তর আমেরিকার একাধিক গুরুত্বপূর্ণ প্রদর্শনীতে অংশগ্রহনের সুযোগ পান। সেখানে পড়াকালীন টেম্পেরা টেকনিক ও ভাস্কর্যে শিক্ষা লাভ করেন যা পরবর্তীতে তাঁর কর্মজীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।
শিল্পী জীবনে আবদুর রাজ্জাক বিভিন্ন মাধ্যমে কাজ করেছেন এবং প্রতিটি মাধ্যমেই প্রতিভার চূড়ান্ত স্বাক্ষর রেখেছেন। বিভিন্ন মাধ্যমে কাজ করা প্রসঙ্গে শিল্পী নিজেই বলেছেন, “একমাত্র এভাবেই শিল্পী পরিপূর্ণতা পান। ত্রিমাত্রিক ভাস্কর্য-শিল্পের অনুশীলন ছাড়া বস্তুর আকারগত পদ্ধতি বা ফর্ম-সম্পর্কে ধারণা পরিষ্কার হয় না। তেমনি পেইন্টিং করা ছাড়া রঙের প্রকৃতিও বোঝা শক্ত। অন্যদিকে ড্রয়িং বুঝতে সাহয্য করে রেখার সাবলীলতা। পেইন্টিংয়ের চুড়ান্ত সাফল্য অর্জন করতে হলেও ভাস্কর্যের ফর্মগুণ এবং ড্রয়িংয়ের রেখার গুণ প্রয়োজন।” এই বিশ্বাস থেকেই তিনি বহু মাধ্যমে কাজ করেছেন।
১৯৬৩ সালে ভাস্কর্য বিভাগের দায়িত্ব নেয়ার পর একে প্রতিষ্ঠিত করতে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৭২ সালে বিমানবাহিনীর সদর দফতরের জন্য নির্মাণ করেন ‘শাহীন’ নামের সাদা-কালো ভাস্কর্য। একই বছর তিনি গাজীপুরের চৌরাস্তার স্থাপিত বহুল প্রশংসিত ‘জাগ্রত চৌরঙ্গী’ ভাস্কর্যটি গড়ে তোলেন। শিক্ষকতা থেকে অবসর গ্রহণের পরও এঁকেছেন একের পর এক ছবি।
১৯৬২ সালের দিকে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের ভ্রাতুস্পুত্রী মুস্তারী বেগমের সাথে রাজ্জাক বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। দুই ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে তিনি একটি সুখী পরিবারের গর্বিত সদস্য ছিলেন। কিন্তু ১৯৮৯ সালের মে মাসে এক দুর্ঘনায় তাঁর ছোট ছেলে প্রতিভাবান তরুণ শিল্পী আরিফ আহমেদ তনু মারা যান। এ ঘটনার পর শোকাহত রাজ্জাক বেশ কিছুদিন শিল্পকর্ম থেকে দূরে ছিলেন কিন্তু পরে উপলব্ধি করেছিলেন, এ রকম দুঃসময় থেকে উত্তরণের উপায়ও একমাত্র শিল্পচর্চা। শিল্পই তাঁকে দু’দণ্ড শান্তি দিতে পারে সব দুঃখ থেকে। তাই আবার তিনি ছবি আঁকায়, ভাস্কর্য নির্মাণে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। বাস্তু-পরিবেশের সীমাবদ্ধতা কখনোই তাঁর শিল্পতাড়নাকে স্তিমিত করতে পারে নি। অনবরত কাজ করার মধ্যেই যেন তিনি বেঁচে থাকার আনন্দ ও সার্থকতা খুঁজে পান।
জীবনে আবদুর রাজ্জাক অনেক ছবি এঁকেছেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য- ‘সোয়ারীঘাট’, ‘নৌকা নির্মাণ’, ‘আত্মপ্রতিকৃতি’, ‘অভ্যন্তর’, ‘বাগান’, ‘জলাশয়’, ‘মুসা খানের মসজিদ’ ইত্যাদি।
শিল্পী রাজ্জাক ভাস্কর্যকে একটি আধুনিক শিল্প মাধ্যম রূপে প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাঁর নেতৃত্বে এ বিষয়ে একটি সুচিন্তিত সম্পূর্ণ আধুনিক শিক্ষা কার্যক্রম বিকশিত হয় এবং একই সময়ে তিনি নিজেকে ভাস্কর্য শিল্প সৃষ্টিতে আত্মনিয়োগ করেন। স্বাধীনতা লাভের পরপরই বাংলাদেশ বিমান বাহিনী তাঁকে দশ ফুট উচ্চতার ‘শাহীন’ ভাস্কর্য নির্মাণের দায়িত্ব প্রদান করে। একই সময়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আমন্ত্রণে তিনি জয়দেবপুর চৌরাস্তার উন্মুক্ত চত্বরে সংস্থাপিত সুবিশাল ‘মুক্তিযোদ্ধা’ ভাস্কর্যটি সৃষ্টি করেন। কংক্রিটের তৈরি এই ভাস্কর্যে আঠারো ফুট দীর্ঘ এক মুক্তিযোদ্ধার মূর্তি চবিবশ ফুট উঁচু বেদির উপর স্থাপন করা হয়। ‘জাগ্রত চৌরঙ্গী’ নামে সুপরিচিত এই ভাস্কর্যটি একাত্তরের পঁচিশে মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যার বিরুদ্ধে বাঙালি সৈনিকদের বীরত্বপূর্ণ প্রতিরোধের স্মারক। এই স্মৃতিসৌধে একজন সাহসী মুক্তিযোদ্ধাকে এক হাতে রাইফেল এবং অন্য হাতে গ্রেনেড নিয়ে আগ্রাসী শত্রুদের মোকাবিলা করতে দেখা যায়। জনবহুল উন্মুক্ত স্থানে বিশাল মানবমূর্তি স্থাপন বাংলাদেশে ভাস্কর্যকলা মাধ্যমে একটি সম্পূর্ণ নতুন মাত্রা যুক্ত করে। ভাস্কর্যের মধ্যে আরো উল্লেখযোগ্য- ‘কম্পোজিশন’, ‘নারী মুখমন্ডল’, ‘খাড়া-গড়ন’ ইত্যাদি।
১৯৮৯ সালে শিল্পকর্মের সামগ্রিক স্বীকৃতি স্বরূপ জাতীয় পর্যায়ের শ্রেষ্ঠতম পুরস্কার একুশে পদকে ভূষিত হয়েছেন তিনি । একই বছর বাংলাদেশ চারুশিল্পী সংসদ সম্মান লাভ করেন।
২০০৫ সালের ২৩ অক্টোবর যশোরে একটি চিত্রাঙ্কন কর্মশালায় কর্মরত অবস্থায় হূদরোগে আক্রান্ত হলে তাঁর জীবনাবসান ঘটে।
আব্দুর রাজ্জাক শরীয়তপুর তথা বাংলাদেশের গর্ব।
আপনার মতামত দিন